গণিতচর্চা, কোরআনের অনুপ্রেরণা
আধুনিক সময় ও সভ্যতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দাঁড়িয়ে আছে গণিতের ওপর। গণিতই আধুনিক বিজ্ঞানের প্রাণসত্তা। মানবসভ্যতার জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই গণিতচর্চায় আছে পবিত্র কোরআনের অনুপ্রেরণা এবং সেই অনুপ্রেরণার কারণে যুগে যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা গণিতশাস্ত্রের উন্নয়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন।
কোরআনের অনুপ্রেরণা
পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ হিসাব ও পরিমিতিবোধের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং নিজেকে ‘হিসাব গ্রহণকারী’ আখ্যা দিয়ে মানুষকে গণিতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।
যেমন—
১. আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন হিসাবমতো : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি সব কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে। ’ (সুরা : কামার, আয়াত : ৪৯)
যেহেতু আল্লাহ সব কিছু পরিমাপ তথা হিসাব অনুযায়ী সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং মানুষের প্রাত্যহিক জীবনেও হিসাব রক্ষা করা আবশ্যক।
২. গ্রহ-নক্ষত্র চলে হিসাবমতো : আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি গ্রহ-নক্ষত্রও নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘সূর্য ও চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে। ’
(সুরা : আর-রহমান, আয়াত : ৫)
৩. আল্লাহ হিসাব গ্রহণকারী : মহান আল্লাহ নিজেকে হিসাব রক্ষাকারী আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘অতঃপর তাদের প্রকৃত প্রতিপালক আল্লাহর দিকে তারা প্রত্যানীত হয়। দেখো, কর্তৃত্ব তাঁরই এবং হিসাব গ্রহণে তিনিই সর্বাপেক্ষা তৎপর। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৬২)
উল্লিখিত আয়াতে ‘হিসাব গ্রহণে তিনিই সর্বাপেক্ষা তৎপর’ বাক্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, হিসাব তথা গণিতে পারদর্শী হওয়া প্রশংসনীয়।
৪. আল্লাহ হিসাব শেখাতে চান : মহান আল্লাহ বান্দাকে হিসাব শেখাতে চান। বান্দা যেন হিসাব শিখতে পারে সে জন্য তাদেরকে প্রয়োজনীয় উপায় ও উপকরণ দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি রাত ও দিনকে করেছি দুটি নিদর্শন, রাতের নিদর্শন অপসারিত করেছি এবং দিনের নিদর্শনকে আলোকপ্রদ করেছি, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং যাতে তোমরা বর্ষ-সংখ্যা ও হিসাব জানতে পারো। আর আমি সব কিছু বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। ’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১২)
৫. সঠিক পদ্ধতিতে হিসাব করতে হবে : মানুষের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে হিসাব করা আবশ্যক। কেননা আল্লাহ হিসাব শেখার উপকরণগুলো যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি নিজেও যথাযথভাবে হিসাব গ্রহণ করবেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তার মানজিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন। ’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৫)
গণিতশাস্ত্রে মুসলমানের অবদান
প্রাচীন কালে মুসলিম বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের যেসব মৌলিক শাখায় অবদান রেখেছেন গণিতশাস্ত্র তার অন্যতম। মুসলিম বিজ্ঞানীরা যেমন গ্রিক ও ভারতীয়দের আবিষ্কৃত গণিতের সূত্রগুলো বিশ্লেষণ ও উন্নয়ন করেছেন, তেমনি গণিতশাস্ত্রে নিত্যনতুন তথ্য ও শাখা যুক্ত করেছেন। গণিতশাস্ত্রে অবদান রেখেছেন এমন কয়েকজন মুসলিম বিজ্ঞানী হলেন—
১. আল-খাওয়ারিজমি : আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমির জন্ম মধ্য এশিয়ায়। মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই গণিতশাস্ত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন। তাঁকে বলা হয় আধুনিক বীজগণিত তথা অ্যালজেবরার জনক। তাঁর বই ‘কিতাবুল জাবার ওয়াল মুকাবিলা’-কে অ্যালজেবরা বা বীজগণিতের উৎস গণ্য করা হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের প্রাণসত্তা বলা হয় তাঁর আবিষ্কৃত বীজগণিতকে। কেননা আধুনিক যুগের প্রায় সব কিছু এই বীজগণিতের ওপর নির্ভর করে আবিষ্কৃত হয়েছে। পাটিগণিত বিষয়েও তিনি একটি বই রচনা করেন, যা পরে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়।
২. আল-কারজি : আল-খাওয়ারিজমির বীজগণিতের ধারণার প্রসার ঘটান আল-কারজি। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি বীজগণিতকে জ্যামিতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করেন এবং পাটিগণিতের সঙ্গে বীজগণিতের যোগসূত্র তৈরি ও ব্যাখ্যা করেন, যা আধুনিক বীজগণিতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলভিত্তি। তিনিই প্রথম বীজগণিতের সূচক আবিষ্কার করেন।
৩. আল-বেরুনী : আল-খাওয়ারিজমির পরেই গণিতবিদ হলেন আল-বেরুনীর স্থান। তাঁর রচিত ‘আল-কানুন আল-মাসউদি’-কে গণিতশাস্ত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠতম অবদান বলা হয়। গ্রন্থটিকে কেউ কেউ গণিতশাস্ত্রের বিশ্বকোষ বলে থাকে। আল-বেরুনী তাঁর এই গ্রন্থে জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস প্রভৃতি বিষয়ের সূক্ষ্ম, জটিল ও গাণিতিক সমস্যার সমাধান তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া পরিমাপ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা আজও স্বীকৃত ও অনুসৃত।
৪. ওমর খৈয়াম : কবি ও গণিতবিদ ওমর খৈয়ামের ব্যাপারে বলা হয় তিনি দিনে জ্যামিতি ও বীজগণিত পড়াতেন, সন্ধ্যায় মালিক শাহের দরবারে পরামর্শ দিতেন এবং রাতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা করতেন। তিনি প্রথম উপবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। ওমর খৈয়ামের ‘মাকালাতু ফি আল জাবর ওয়াল মুকাবিলা’-কে গণিতশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মনে করা হয়। এই গ্রন্থে তিনি ঘাত হিসাবে সমীকরণের শ্রেণিকরণ করেন এবং দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানের নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করেন।
৫. আল-বাত্তানি : আবদুল্লাহ আল-বাত্তানিকে খ্রিস্টীয় নবম ও দশম শতকের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ মনে করা হয়। গণিতশাস্ত্রের উন্নয়নে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। ত্রিকোণমিতির অনুপাত প্রকাশ আল-বাত্তানির মৌলিক অবদান। গণিতশাস্ত্র ইতিহাসে ত্রিকোণমিতিকে আল-বাত্তানিই সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রথম তুলে ধরেন। ত্রিকোণমিতির Sine, Cosine, Tangent, Cotangent ইত্যাদি সাংকেতিক নিয়মের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার তিনিই প্রথম করেন।
আরো কিছু অবদান : উল্লিখিত গণিতবিদরা ছাড়াও আল-সামাওয়াল বীজগণিতের অজানা রাশি নির্ণয়ের ব্যাখ্যা দেন। শারাফ আদ-দ্বিন সমীকরণের মাধ্যমে বক্ররেখাকে ব্যাখ্যা করার সূত্র আবিষ্কার করেন। সাবিত ইবনে কুরা সংখ্যাতত্ত্বের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। মুহাম্মদ বাকির ইয়ার্দি দুই সমধর্মী সংখ্যার জোড়া আবিষ্কার করেন। আবুল ওয়াফা বর্গমূল ও এর বিন্যাস আবিষ্কার করেন। আল-কাশি বাস্তব সংখ্যার দশমিক ভগ্নাংশের ধারণা সম্প্রসারণ করেন।
তথ্যঋণ : ইসলাম অনলাইন ডটনেট ও মুসলিম সভ্যতার ১০০১ আবিষ্কার
আপনার মতামত জানান