লোড শেডিংয়ে ফ্রিল্যান্সারদের কাজ ও আয় কমছে
রাতের বেলায় লোড শেডিংয়ের কারণে ইন্টারনেট সংযোগ বিঘ্নিত হওয়ায় প্রযুক্তি খাতের ফ্রিল্যান্সার এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্ভোগ বাড়ছে। তাদের কাজ ও আয় দুটিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশি কর্মীদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অভ্যন্তরীণ প্রবাস আয় বা ইন্টারনাল রেমিট্যান্সে।
ডলার ও প্রবাস আয়ের সংকটের এই সময়ে ফ্রিল্যান্সিং খাতকে কাজে লাগাতে পারলে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসতে পারত। কিন্তু চিরাচরিত ধীরগতির ইন্টারনেটের সঙ্গে লোড শেডিং যুক্ত হয়ে সেই সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স আয় হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে, ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ মার্কিন ডলার, আগস্টে যা ছিল ২০৪ কোটি ডলার।
ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং থেকে বছরে আয় করে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। মাসে গড়ে ৮৩৩ কোটি টাকা। এই অর্থ অভ্যন্তরীণ প্রবাস আয় হিসেবে গণ্য হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে এ খাতের আয় দু-তিন গুণ বাড়াতে চায় সরকার।
ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওকলার গত জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ইন্টারনেটের গতির দিক থেকে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম। ইন্টারনেটের গতি পর্যালোচনাকারী ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কেবলডটকো ডট ইউকের তথ্য মতে, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতির দিক থেকে ২২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৫তম।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা সাড়ে ছয় লক্ষাধিক। তাঁদের বেশির ভাগই কাজ করেন ফ্রিল্যান্সিং সাইট আপওয়ার্ক ও ফাইভারে। এর বাইরে বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়মিত কাজ করছেন আরো লাখখানেক কর্মী।
ফ্রিল্যান্সারদের অভিযোগ, মাত্রাতিরিক্ত লোড শেডিংয়ের পাশাপাশি ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে তাঁরা সময়মতো কাজ প্রস্তুত ও বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন না।
বিশ্বের ‘টপ রেটেড’ (কাজের সংখ্যা, আয় ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে) ফ্রিল্যান্সারের ৬৪ শতাংশই বাংলাদেশি। এই ফ্রিল্যান্সারদের অনেকেই গ্রামে বাড়িতে থেকেও কাজ করছেন। এত দিন তাঁদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দুর্বল নেটওয়ার্ক ও ধীরগতির ইন্টারনেট। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত লোড শেডিং। দফায় দফায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় বিদেশি বায়ারদের পাঠানো বার্তার উত্তর সময়মতো দেওয়া সম্ভব হয় না অনেক ক্ষেত্রে। ফলে বায়াররা কাজ অন্য কোথাও দিয়ে দিচ্ছেন।
বগুড়ার ফ্রিল্যান্সার রাব্বি রহমান বলেন, ‘আগে রাত ১২টার পর বিদ্যুৎ মোটামুটি থাকত, এখন কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ বিদেশের বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগের মূল সময়টা রাত। কাজ পাওয়া, শেষ করা এবং নির্দিষ্ট সময়ে কাজ জমা দেওয়ার জন্য দিনেও লম্বা সময় ধরে নেটওয়ার্কে থাকতে হয়। তাই আমাদের জন্য রাতদিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকাটা জরুরি। ’
রাব্বি রহমান জানান, আগে মাসে তিনি দু-তিন হাজার ডলার (দু-তিন লাখ টাকা) অনায়াসেই আয় করতে পারতেন, দুই মাস ধরে তা অর্ধেকে নেমেছে।
রাঙামাটির ফ্রিল্যান্সার আক্তার হোসেন বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের সমস্যার কারণে সময়মতো কাজ জমা দিতে না পারায় আমার প্রফাইলে নেতিবাচক রিভিউ দিয়েছে একাধিক ক্লায়েন্ট। এর ফলে নতুন কাজ পেতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। নেতিবাচক রিভিউ থাকলে নতুন ক্লায়েন্টরা কাজ দিতে ভয় পায়। অথচ দক্ষ কাজের প্রমাণ দিয়ে দীর্ঘদিনের চেষ্টায় প্রফাইলটাকে ভালো একটা অবস্থায় নিয়েছিলাম। ’ তিনি আরো বলেন, গত মাস থেকে শোড শেডিং বেড়ে যাওয়ায় আয়ও অনেকটা কমে গেছে।
ঢাকার ফ্রিল্যান্সার শহিদুল ইসলামের অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। তিনি বলেন, ‘কাজ বেড়ে যাওয়ায় ভালো গতির নেট পেতে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছি। এখন এখানেও যন্ত্রণা বিদ্যুৎ নিয়ে। ’ তাঁরও আয়ে প্রভাব পড়েছে বলে জানালেন তিনি।
ঢাকাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডরের (আইএসপি) ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের (ওয়াই-ফাই) গতিও সন্তোষজনক নয়। তা ছাড়া বিদ্যুৎ না থাকলে বিকল্প উপায়ে ওয়াই-ফাই চালু রাখার ব্যবস্থাও নেই অনেক আইএসপির। তাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চয় ও সরবরাহের ডিভাইস আইপিএস (ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই) ব্যবহার করে রাউটার চালু রেখেও লাভ হচ্ছে না গ্রাহকদের।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ফ্রিল্যান্সার রাকিবুল ইসলাম জানান, অনেকেই এখন বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎ ও সোলার নির্ভর আইপিএস ব্যবহার করছে। লোড শেডিংয়ের সময় ইন্টারনেট সমস্যা হলেও অন্তত হাতে জমা কাজগুলো সারা যাচ্ছে এই বিকল্প উপায়ে।
তিন বছর আগে ‘ডিজিটাল সিলেট সিটি’ প্রকল্পের আওতায় ফ্রি ওয়াই-ফাই সেবা দিতে সিলেট সিটি করপোরেশনের ৬২ এলাকার ১২৬টি স্থানে ব্রডব্যান্ড রাউটার স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এর সুফল পাচ্ছে না স্থানীয় ব্যবহারকারীরা। তাদের আক্ষেপ, নেটওয়ার্ক সুবিধা আশানুরূপ নয়। ফলে এই সুবিধাকেও কাজে লাগাতে পারছেন না স্থানীয় আউটসোর্সিংকর্মীরা।
শীর্ষস্থানীয় দুই মোবাইল ফোন অপারেটরকে নেটওয়ার্ক ও প্রযুক্তি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান জেটটিইর প্রযুক্তি প্রকৌশলী মুনতাসির অমিত জানান, দেশের মোবাইল ফোন অপারেটররা খরচ কমাতে গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ডাটার স্পিড বা সরবরাহ সীমা সাধারণত কমিয়ে রাখে। কারণ শহরের তুলনায় গ্রামে ডাটা ব্যবহারকারী কম। তিনি জানান, বিদ্যুৎ চলে গেলে বিকল্প ব্যবস্থায় (ব্যাটারি বা জেনারেটরে) নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কথা বলার উপযোগী নেটওয়ার্ক ও ডাটা সরবরাহ ব্যবস্থা সচল থাকে। তবে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকলে ফোরজি সেবা সচল রাখা সম্ভব হয় না। গ্রামাঞ্চলে মোবাইল ফোনের টাওয়ারের বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থার সরঞ্জাম প্রায়ই চুরি হয়, এসব কারণেও সেবা ব্যাহত হয়।
তবে মোবাইল ইন্টারনেট সমস্যা নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের মোবাইল ফোন অপারেটরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদ্যুতের কারণে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়া বর্তমানে কঠিন হয়ে পড়েছে।
গুগল-ফেসবুক থেকে আয়েও ভাটা
বিপত্তি শুধু ফ্রিল্যান্সিংয়েই নয়, যাঁরা ফেসবুক-ইউটিউবে ভ্লগিং এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ব্লগিং করছেন, লোড শেডিংয়ের কারণে তাঁদেরও কাজের পরিধি কমেছে। ফলে গুগল-ফেসবুক থেকে তাঁদের আয়ও কমছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সভাপতি তানজিবা রহমান বলেন, যেহেতু ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের একটা বড় অংশ রাতে হয় তাই এ সময় লোড শেডিং আর্থিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। কাজ ও আয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
রাজধানীতে গড়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা করে লোড শেডিং হচ্ছে। ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ জেলাশহর ও গ্রামাঞ্চলে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা করে লোড শেডিং হচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাওসার আমীর আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডেসকোর আওতায় রুটিন অনুযায়ী তিন ঘণ্টা করে লোড শেডিং করার কথা থাকলেও তা মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় রুটিনের বাইরেও লোড শেডিং দিতে হচ্ছে। ’
আপনার মতামত জানান