চুনকা পরিবার নাসিকের প্রাণ
চুনকা পরিবারই নাসিকের প্রাণ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের ৫০ বছরের অর্ধেক সময় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা ও বর্তমানের সিটি কর্পোরেশনে দায়িত্বে পালন করেছেন নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত চুনকা পরিবার। মোট ৩১ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসকের মধ্যে ৩০ বছর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আর বাকি সময় প্রশাসকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে শহর। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে নাজিম উদ্দিন মাহমুদের সাড়ে ৪ বছর বাদ দিলে বাকি সময় শহরের নেতৃত্ব দিয়েছেন আলী আহাম্মদ চুনকা ও তাঁর বড় কন্যা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।
ইতিহাস বলছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের চাবি বরাবরই ছিল চুনকা পরিবারের হাতে। স্বাধীনতার পর প্রথম পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলী আহাম্মদ চুনকা এবং বর্তমানে তারই কন্যা দ্বিতীয় দফায় সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আগামীকাল তৃতীয় দফায় তিনি নৌকা প্রতিকের প্রার্থী।
আলী আহাম্মদ চুনকা একটানা দু’বার নির্বাচিত হয়ে ৮ বছর পৌর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। কন্যা আইভীও টানা তিন মেয়াদে পৌর চেয়ারম্যান ও সিটি মেয়র হিসেবে মোট ১৮ বছর আগলে রাখছেন এই শহর। কন্যা ও পিতা দু’জনই বিএনপির শাসনামলেও আওয়ামী লীগের সমর্থনে ভোটের লড়াই উতরেছেন দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে। জনসম্পৃক্ততা ও জনসমর্থনই তাদের এই জয় এনে দিয়েছে একাধিক সময়ে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে আলী আহাম্মদ চুনকা ও কন্যা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০০৩ সালে খালেদা জিয়ার সময়ে বিরাট ব্যবধানে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী পৌরসভা ছিল।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তৎকালীন জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলী আহাম্মদ চুনকা। শহরের অবকাঠামো উন্নয়ন ও উন্নত নাগরিক সেবা প্রদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নগরবাসী ৩ বছর পর ১৯৭৭ সালে পুনরায় আলী আহাম্মদ চুনকাকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ৫ বছর পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে নানা কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এই সময়ে চারজন প্রশাসক পৌরসভার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে নাজিম উদ্দিন মাহমুদ পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সাড়ে ৪ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর সীমানা জটিলতাসহ নানা কারণে দীর্ঘ ১৫ বছর আর এই পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এই দীর্ঘ সময় নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় বিভিন্নজন পৌর প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৩ সালে পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে জয়লাভ করেন সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আলী আহাম্মদ চুনকার জ্যেষ্ঠ কন্যা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। নগরবাসী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধ ও সমর্থনে পৌর নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। ওই বছরের ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন আইভী। ওই সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন নুরুল ইসলাম সরদার। তার পিতা তারু সরদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কমিশনার এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা।
তবে সদ্য রাজনীতিতে প্রবেশ করা সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে বিপুল ভোটে ধরাশায়ী হন বিএনপির এই প্রার্থী। পৌরসভার ১২৭ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে জয়ের ইতিহাস গড়েন আইভী। প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থীকে হারান তৎকালীন শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবার বিষয়ক সম্পাদক ডা. আইভী। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে মোমবাতি মার্কায় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। বিপুল ভোটে জয় লাভ করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ও ২০১১ সাল পর্যন্ত আরও তিন বছর পৌর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করা হয়।
ওই বছরের ৩০ অক্টোবর নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। ওই নির্বাচনে ডা. আইভীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগেরই প্রভাবশালী নেতা সাবেক সাংসদ (বর্তমানেও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ) একেএম শামীম ওসমান। শেষ মুহুর্তে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাড. তৈমুর আলম খন্দকারের সরে দাঁড়ানো, বিএনপির ভোট বর্জনের ঘোষণাসহ নানা নাটকীয়তার পর প্রায় লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে শামীম ওসমানকে হারান চুনকা কন্যা সেলিনা হায়াৎ আইভী। এবার কেবল নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়া নয়, বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত নারী মেয়র হওয়ার সম্মানও অর্জন করেন আইভী।
এরপর ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার প্রার্থী হয়ে আবারও মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। দ্বিতীয় দফায় সিটি মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন আইভী। ২০০৩ সালে আইভী যখন মেয়রের চেয়ারে বসেছিলেন, তখন পৌরসভার দেনা ছিল দুই কোটি আট লাখ টাকা। রাস্তায় ঠিক মতো বাতি জ্বলত না, একটু বৃষ্টি হলেই শহরে হাঁটুপানি জমে যেত। শহরের অনেক গলিতেই একটা রিকশা প্রবেশ করলে আরেকটা বের হতে পারতো না। আইভী দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৮ বছরে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে।
শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ব্যাপক কাজ করেছেন তিনি। আধুনিক ও বাসযোগ্য নগরী গড়তে নিয়েছেন নারী-শিশু ও পরিবেশ বান্ধব অনেক প্রকল্প। আজকে এই শহরের প্রত্যেক গলিতে বড় সড়ক এবং প্রধান প্রধান সড়ক প্রয়োজনের থেকেও বেশি প্রশস্থ। দখলদারদের কাছ থেকে খাল, পুকুর পুনরুদ্ধার, জমি উদ্ধ্বার করে মাঠ-পার্ক, মসজিদ-মন্দির করেছেন। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ, শহরকে আলোকিত করার জন্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি বাতি স্থাপন করেছেন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনে বাবুরাইল ও সিদ্ধিরগঞ্জ খাল পুনরুদ্ধার ও সৌন্দর্যবর্ধন ও কদম রসুল সেতু নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন ও দেশীয় সংস্কৃতি বিকাশে পাঠাগার নির্মাণ করেছেন। স্বাস্থ্যসেবায় নগর ক্লিনিক স্থাপন করেছেন।
আগামীকাল নাসিক নির্বাচনে নৌকা প্রতিক নিয়ে বিএনপি’র প্রভাবশালী নেতা (সাবেক) তৈমুর আলম খন্দকারের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে নামছেন আইভী। তবে গত ৫ দশকের প্রতিটি নির্বাচন থেকে আলাদা মর্যােদা পাচ্ছে আগামীকালের নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একটা প্রভাবশালী পক্ষ, জাতীয় পার্টির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং বিএনপির নেতা কর্মীরা তৈমুরের পক্ষে ভোট যুদ্ধে সৈনিকের মতো কাজ করছেন। এরপরও আইভী বিজয়রথে কতটুকু প্রভাব পড়বে কিংবা আইভী এবার কত ভোটের ব্যবধানে জয় পরাজয়ের নতুন সমীকরণ তৈরি করবেন এটা দেখতে সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে নাসিক নির্বাচনের দিকে। এখন দেখার বিষয় কতদিন নগর রক্ষার এই চাবি চুনকা পরিবারের হাতে থাকে।
একটা বিষয় স্পষ্ট চুনকা পরিবার শ্রমিক ও সাধারন মানুষের অধিকার আদায় এবং প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন। নাসিকের সফলতার সব ইতিহাস চুনকা পরিবারের। তাই ভোটাররাও মুখিয়ে আছে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে।
আপনার মতামত জানান