প্রথমবার গাড়ি দেখলো যে উপজেলার মানুষ
এই প্রথম চার চাকার গাড়ি দেখলো নেত্রকোনার খালিয়াজুরী হাওর উপজেলার মানুষ। প্রথমবারের মতো গাড়িটিও তার ঠিকানায় ফিরলো। বরাদ্দের পর থেকেই এখানে ওখানে দিন কেটেছে গাড়িটির। আপন ঠিকানায় পৌঁছায়নি কোনোদিন।
ওই উপজেলা শহরে কখনো চলেনি চার চাকার গাড়ি। গত বছর মাত্র তিনটি অটোরিকশা চলতো পুরো উপজেলা শহরে। তাইতো নতুন জামাই দেখার মতো কৌতুহলে প্রথম চার চাকার গাড়ি দেখছিল স্থানীয়রা।
যদিও সরকার ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে করে দিয়েছে ডুবন্ত সড়ক। কিন্তু একটি মাত্র সেতুর অভাবে এই শহরে চার চাকার গাড়ি দেখেনি কেউ কোনোদিন।
জীবনে প্রথমবার গাড়ি দেখলো যে উপজেলার মানুষ
স্থানীয়রা বলছেন, ধনু নদীতে একটি সেতু হলে বদলে যেতো পুরো অঞ্চলের চিত্র।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, লাল ও কালো রঙের দু’টি চার চাকার গাড়ি চলার দৃশ্য দেখতে রাস্তার দুইপাশে ভিড় জমান শত শত মানুষ। গাড়িগুলো প্রত্যন্ত হাওরের পথ ধরে যেতে যেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে গিয়ে হাজির হয়। সে সময় চারপাশে জড়ো হয় ছেলে বুড়োসহ শত শত মানুষ। তাদের চোখেমুখে অন্য রকম এক আনন্দ। আর এ স্মৃতিকে ধরে রাখতে অনেকে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তোলেন।
এই দু’টি গাড়িই খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের মাটিতে চলা প্রথম কোনো চার চাকার গাড়ি। এর আগে আর কোনোদিন এই উপজেলা সদরে প্রাইভেটকার, জিপ কিংবা ট্রাক পৌঁছেনি।
তবে খুব সহজে গাড়িগুলো সেখানে পৌঁছায়নি। পোহাতে হয়েছে নানা ঝক্কি ঝামেলাও। নৌকায় পার হতে হয়েছে ধনু নদী। আর সেজন্য কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থেকে আনতে হয়েছে ইঞ্জিনচালিত প্রশস্ত নৌকা। নদীর পাড় পার হতে নির্মাণ করতে হয়েছে অ্যাপ্রোচ সড়ক।
আর এসব মোকাবিলা করতে হয়েছে ফাইজার কোম্পানির কোভিড-১৯ টিকা পৌঁছে দিতে। ফাইজার টিকা সরবরাহ করতে হয় ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রার গাড়িতে করে। কিন্তু রাস্তার অভাবে দুর্গম জনপদ খালিয়াজুরীতে গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয়।
এমন চিন্তা করে খালিয়াজুরীর টিকা কার্যক্রম পার্শ্ববর্তী মদন উপজেলা সদরে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু বাঁধ সাধে ওই উপজেলার সচেতন মহল। তারা ৩০ কিলোমিটার দূরে মদনে গিয়ে টিকা গ্রহণে আপত্তি জানান। তারা যেকোনো উপায়ে খালিয়াজুরীতে টিকা পৌঁছানোর অনুরোধ করেন স্থানীয় প্রশাসনকে।
জীবনে প্রথমবার গাড়ি দেখলো যে উপজেলার মানুষ
এলাকাবাসীর দাবির প্রক্ষিতে এগিয়ে আসেন খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম আরিফুল ইসলাম। তিনি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশেষায়িত গাড়ি দিয়েই খালিয়াজুরীতে টিকা পৌঁছানোর উদ্যোগ নেন।
টিকা নিয়ে যাওয়া গাড়ি দুটির মধ্যে লাল রঙের গাড়িটি খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। আর কালো গাড়িটি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার। গাড়ি বরাদ্দ থাকলেও খালিয়াজুরী উপজেলা সদরে এর আগে কোনোদিন তাদের গাড়ি পৌঁছায়নি।
খালিয়াজুরী সদরের পুরানহাটি গ্রামের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, খালিয়াজুরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক দুর্গম। ২০১৭ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন খালিয়াজুরী উপজেলা সদর সফর করেন তখন তার গাড়িও আনা সম্ভব হয়নি। তিনি হেলিকপ্টারে এসেছিলেন। হেলিকপ্টার থেকে নামার পর একটি রিকশায় চড়েন তিনি। খালিয়াজুরীবাসীর দুঃখ ধনু নদী। ওই নদীতে একটা সেতু খুব জরুরি দরকার।
খালিয়াজুরী সদরের রঞ্জিত সরকারের স্ত্রী আশা রাণী সরকার (৬৩) বলেন, জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, এত সুন্দর গাড়ি দেখিনি। কেউ অসুখে মারা গেলেও কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। নদীর এপারে ধানের দাম দেড়শো থেকে দুইশো টাকা কম। এরকম গাড়ি আসলে আমরা ধানের ঠিক দাম পাইতাম।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম আরিফুল ইসলাম বলেন, একটি বড়ো ট্রলারের পাটাতনে কাটের তক্তা বসিয়ে পার করা হয় উপজেলা প্রশাসনের জন্য নির্ধারিত গাড়িসহ স্বাস্থ্য বিভাগের গাড়িটি। ৩০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে টিকা নিতে অনেকে আপত্তি তোলায় আমরা এ চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছিলাম। আমরা তাতে সফল হয়েছি। শুধু গাড়ি পৌঁছাইনি, টিকাগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখার জন্য আমরা একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেরও ব্যবস্থা করেছি।
আপনার মতামত জানান