দু’হাত হারানো সেই ফাল্গুনী বিয়ের পিঁড়িতে
২০০২ সাল। ফাল্গুনী সাহার বয়স তখন মাত্র ৫ বছর। একদিন বাড়ির ছাদে বৈদ্যুতিক তারে বিদ্যুতায়িত হলে তার শরীর থেকে দুই হাতেই কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন করতে হয়। সেই থেকে অন্যভাবে পথচলা শুরু ফাল্গুনীর। তার অদম্য মনোভাব হার মানাতে পারেনি। ২০১১ সালে মাধ্যমিক, ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। আর গত বুধবার রাতে সাতপাকে বাঁধা পড়েছেন সেই ফাল্গুনী। বসেছেন বিয়ের পিঁড়িতে।
নগরীর বিএমকলেজ রোড এলাকায় বসবাসকারী ফাল্গুনী পটুয়াখালি জেলার গলাচিপা উপজেলার সদরের বাসিন্দা। তিনি ব্র্যাক বরিশাল শাখার অফিসে সহকারী প্রশাসনিক কর্তকর্তা। বুধবার রাতে বরিশাল নগরীর ঐতিহ্যবাহি শ্রী শ্রী শংকর মঠ মন্দির প্রাঙ্গনে উন্নয়ন সংস্থা কোডেক পটুয়াখালী শাখার মাঠ কর্মকর্তা সুব্রত মিত্রর সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ে উভয় পরিবারের সম্মতিতেই হয়েছে বলে তারা জানান। এ বিয়ে দেখতে স্থানীয় উৎসুক মানুষও জড়ো হয়েছিলেন মন্দির প্রাঙ্গণে। এ সময়ে বর সুব্রত মিত্রর মহানুভবতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশংসা করেন তারা।
শ্রী শ্রী শংকর মঠের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব কর্মকার ভাষাই বলেন, এই বিয়ে আমার কাছে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই বিয়ে দেখে আমি অবাক হয়েছি। একটা মেয়ের দুইটি হাত নেই, তাকে একটি ছেলে বিয়ে করেছে। এমন মহানুভবতা দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদের। আমার জীবদ্দশায় দেখিনি একজন দুই হাতহারা মেয়েকে এমন স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছেন। আমরা সুব্রত মিত্রর হৃদয় কতখানি বড় সেটা বুঝতে পেরেছি। সত্যিই আমরা অভিভূত।
ফাল্গুনী সাহা বলেন, ২০০২ সালে গলাচিপায় আমাদের পাশের বাড়ির ছাদে বসে বৈদ্যুতিক তারে দুর্ঘটনার কারণে দুই হাতই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমি নিজেকে কখনো দুর্বল মনে করিনি। দুই হাতের যতটুকু অংশ ছিলো, ততটুকু অংশ দিয়েই আমি আমার পড়াশুনা শেষ করেছি এবং এখন চাকরিও করছি। আমি ২০১১ সালে মাধ্যমিক পাস করেছি গলাচিপা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে। ২০১৩ সালে উত্তরা ট্রাস্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেই। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওলোজি ও এনভায়রনমেন্ট সাবজেক্টে ২০১৮ সালে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করি। তারপর চাকরি জীবনে প্রবেশ করি।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর মানসিকতা ঠিক থাকলে প্রতিবন্ধকতা কোনো বিষয় নয়। আমাদের বিয়েটা দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে মনে করি। এই পর্যন্ত পৌঁছাতে সকলেরই আন্তরিকতা পেয়েছি। স্কুল জীবন থেকে কর্মজীবনে যারা আমার সাথে ছিলেন তারা কেউ বুঝতে দেননি আমার দুটো হাত নেই। যার মেন্টালিটি ভালো তিনি এগিয়ে আসবেন, যার পক্ষে এমন বিয়ে সম্ভব না তার দূরে থাকাই ভালো। কারো ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না। সকলে আমাদের জন্য আশীর্বাদ ও দোয়া করবেন যাতে সামনের দিনগুলোতে আমরা ভালো থাকতে পারি, ভালো কিছু করতে পারি।
বর সুব্রত মিত্র বলেন, ফাল্গুনীকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। ও যখন ভার্সিটিতে পড়তো, তখন ওর সাথে আমার ফেসবুকে কথা হতো। একটা সময় বুঝতে পারি ও পড়াশুনায় অনেক ভালো করছে। তবে ওর ফ্যামিলি লাইফ বা সামনের দিকে আগানোর কোনো চিন্তা-চেতনা ছিলো না। ওর হাত নেই এটা আমার কাছে কোনো সমস্যা মনে হয়নি। একটা লোকের হাত নেই, তাই সে বিয়ে করতে পারবে না, তার ফ্যামিলি হবে না, এমনটা হতে পারে না এবং এমন চিন্তা আমারও নেই। আমি ওকে স্বপ্ন দেখাই, আমি ওকে ভালোবাসা শেখাই এবং আমি ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানাই। সবশেষ আমরা বিয়েও করেছি। আমরা সামনের দিনে যেন ভালো থাকতে পারি এর জন্য আমাদের জন্য সকলে আশীর্বাদ করবেন।
সুব্রত মিত্রর ছোট বোন শ্রাবন্তী বলেন, আর পাঁচটা বিয়ে যেমন হয়, এখানেও তেমনিভাবে বিয়ে হয়েছে। কোনো ঘাটতি নেই। বরঞ্চ অন্য বিয়ের থেকে এই বিয়ে ভালোভাবে হয়েছে। অনেকেই বলতে পারেন যে, একটা স্বাবলম্বী ছেলে দুই হাত ছাড়া একটি মেয়েকে বিয়ে করছে কীভাবে? আমি বলবো সবার মানসিকতা আমার ভাইয়ের মতো হওয়া উচিত। যাতে বিষয়টি উদাহরণ হয়ে থাকে। আমি মনে করি সারা বাংলাদেশে আমার ভাইয়ের বিয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বিয়েতে আগত অতিথি ও স্বজনরা বলেন, বিয়ের আয়োজনে কোনো ঘাটতি ছিলো না। মঙ্গলবার এখানে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানও হয়েছে। তারা বুধবার সন্ধ্যা থেকেই নাচ গান ও নানাভাবে আনন্দ-মজা করেছে। আনন্দে বেগ দিতে প্রদর্শন করা হয় আতশবাজিরও।
আপনার মতামত জানান