পদোন্নতি প্রদানে নন-মেডিকেল ব্যক্তি: যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না চিকিৎসকদের

প্রকাশিত

অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ

পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করার কারণে চিকিৎসকদের মধ্যে যোগ্যতা বাড়ানোর কোনো প্রতিযোগিতা নাই বলে মন্তব্য করেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সের (নিন্স) পরিচালক ও বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্সেস’র (বিসিপিএস) সভাপতি অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ। এ ছাড়া নন-মেডিকেল ব্যক্তিদের হাতে এ দায়িত্ব থাকায় চিকিৎসকরা অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি।

সম্প্রতি ‘রিফর্মস ইন পোস্টগ্রাজুয়েট মেডিকেল এডুকেশন’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।

এ সময় দেশের মেডিকেল খাতে ব্যবস্থাপনায় নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমরা আরো দু-একটা জায়গায় সর্বনাশের রাস্তা খুলে রেখেছি। আমাদের পদোন্নতির পদ্ধতি হলো ডিপিসি আর এসএসপি। ডিপিসিতে ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপল সিনিয়র কাউন্সিল। এখন সিনিয়ররা বুঝে গেছেন যে, তিনি লেখাপড়া করুন আর না করুন—এক সময় তিনি প্রফেসর হবেনই। যোগ্যতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা নিষ্প্রয়োজন। এজন্য ডাক্তারদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা নাই। আগে সহকারী অধ্যাপক পদে দশজন থাকতেন। তারা জানতেন, পদোন্নতি পেতে প্রতিযোগিতা করতে হবে। তাই সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। এখন আর এসব দরকার নাই। নন-মেডিকেল ব্যক্তিরা চিকিৎসকদের কাগজ-কলম দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। মন্ত্রণালয়ে বসে তারা আমাকে পদোন্নতি দিচ্ছেন। সেজন্য দেখা যায়, আমার ডিপ্লোমা বিক্রি করে দিলেও কিছু যায় আসবে না। আমার সার্টিফিকেট না হলেও চলবে। জানে যে, তাকে ঘুরতে হবে মন্ত্রণালয়ে। কারণ তাকে প্রমোশন দেওয়া হবে মন্ত্রণালয় থেকে।’

কিন্তু খাতা-কলম দিয়ে কখনো মূল্যায়ন করা যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই চর্চা অব্যাহত থাকায় আমরা যোগ্যতা বাড়াতে পারছি না। এতে আমাদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা ব্যবস্থা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজগুলো মূলত তৈরি করা হয়েছে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের জন্য। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেগুলোতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করানো শুরু হয়েছে। সেখানে ফিজিক্যাল স্ট্রাকচার, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, শিক্ষক, সুযোগ-সুবিধা বাড়াইনি। অথচ সক্ষমতার বাইরে ছাত্র ভর্তি করিয়েছি। ঢাকা মেডিকেলে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী আছে এক হাজার, পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী ১ হাজার ৩০০ জন। কিন্তু এই অনুপাতে দক্ষ শিক্ষক নাই। কীভাবে তাহলে আমরা শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করবো? এই বিষয়গুলো আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে হবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি। আমাদের শিক্ষকদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ আপনাদেরকে দেখেই ছাত্ররা শিখবে।’

বিসিপিএস সভাপতি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল শিক্ষাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পাঁচটা বিষয়কে নিয়ে এগুচ্ছি। যেমন: স্কিলড ফিজিশিয়ান, কম্পিটেন্ট টিচার, রিসার্চ ওরিয়েন্টেড টিচার তৈরি এবং ইজি এক্সেস সার্ভিস প্রদান ও এট্যিচিউড অব দ্য ডক্টর উন্নত করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর যা যা আছে, তাহলো: ট্রেইনি বা রেসিড্যান্ট, ফ্যাকাল্টি বা শিক্ষক; বাকিগুলোতে যথেষ্ট শূন্যতা আছে। যেমন: ইনস্টিটিউশন, কারিকুলাম, ট্রেইনি, ইনভায়রনমেন্ট এ্যাসেসমেন্ট ও ফিডব্যাক।

তিনি বলেন, ১৯৭১-২০২১ সাল পর্যন্ত—এই ৫০ বছরে দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল এডুকেশনে ট্রেইনি স্ট্যাটাস, ফিডব্যাক, সেটিসফেকশন নিয়ে কোনো বাস্তবমুখী পড়াশোনা হয়নি। ফলে আমাদের এ সংক্রান্ত আলোচনায় কোনো তথ্য নাই।

অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা আমাদের মিশন-ভিশন নিয়ে কথা গুলো বলছি। কিন্তু এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট পড়াশোনা না হওয়ায় আমরা তথ্যভিত্তিক কোন কথা বলতে পারছি না। তাই বাহিরের দেশের রেফারেন্স দিয়ে কথা বলছি।’

৫০ বছরেও চিহ্নিত হয়নি উচ্চশিক্ষার চ্যালেঞ্জ-দুর্বলতা

পোস্টগ্রাজুয়েশন শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক উদাসীনতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সাল থেকে বিসিপিএস চলছে, আজ পর্যন্ত আমাদের ট্রেইনি নিয়ে কোনো স্টাডি হয়নি। আমরা কোথায় আছি, কোথায় আমাদের দুর্বলতা, কোন কোন জায়গায় চ্যালেঞ্জ—এটা আমরা কেউ সুনির্দিষ্টি কিছু বলতে পারবো না। একইভাবে ২০০৮ সাল থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম চলছে, আজ পর্যন্ত আমরা বলতে পারবো না আমাদের দুর্বলতা বা চ্যালেঞ্জ কী? যদি এ রকম কিছু থাকতো তাহলে আজকে এখানে কথা বলার সুযোগটি আরো বাস্তবমুখী হতো। আমরা সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট দিয়ে কথা বলতে পারতাম। আমি আশা করছি, ভবিষ্যতে এসব বিষয়ে নজর রাখবো।’

তিনি বলেন, ‘ফেলোশিপ বা এমডি-এমএসের আলোচনায় আসি। পার্ট-১ পাস করার পর আমাদের ছাত্ররা প্রশিক্ষণে আসে। ঢাকা মেডিকেলের ট্রেইনি আর টাঙ্গাইল মেডিকেলের ট্রেইনিকে কিভাবে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসবেন? এক কাতারে আসবে না, তাই সবাই ঢাকা মেডিকেলের কিংবা ভালো মেডিকেল ছাড়া ট্রেইনিং নিতে চায় না। এটা কেন হয়, তা সবাই জানেন। বিসিপিএসে বেসরকারি ট্রেইনিদের ২০ হাজার করে ভাতা প্রদানের সময় থেকে আমরা হিসাব করে দেখলাম, ৯০ শতাংশ ট্রেইনি ঢাকাতে। মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাইরে। এমনকি সোহরাওয়ার্দী ও মিটফোর্ডে পর্যন্ত ট্রেইনি পাওয়া যায় না। সব ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইনস্টিটিউটে। তাহলে বলেন, কেন এমন হচ্ছে? এর মূল কারণ সুযোগ-সুবিধা, টিচিং স্টাফের স্বল্পতা। ছেলেরা আসলে কষ্ট করে পড়াশোনা করে, তারা ভালো ট্রেইনি চায়। কিন্তু আমরা সেভাবে ইনস্টিটিউটগুলোর মানের উন্নয়ন ঘটাতে পারিনি। একজন প্রফেসরের সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৬০ জন ট্রেইনি থাকে। তিনি যখন একজন রোগী দেখা শেষ করেন, তখন সর্বশেষ ট্রেইনি রুমে ঢুকে। দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি কী করলেন, কী দেখলেন, কী দেখালেন, তার ৯০ ভাগ ট্রেইনিদের দেখার সুযোগ হয় না।’

শিক্ষার পদ্ধতিগত দুর্বলতায় বাইরে চলে যায় মেধাবীরা

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, এমবিবিএস পাস করলেই বড় ডাক্তার হওয়া যাবে। এখানে যারা ভালো শিক্ষার্থী তারাই আসলে ভালো কিছু করবে। কিন্তু যে মেডিকেলে প্রথম হচ্ছে এবং যে সাপ্লি দিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসছে—দুইজনের একই অবস্থান, যা বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না।

এক সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও মেধার মূল্যায়ন হতো, যারা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতেন তারা সবসময় সম্মানিত হতেন। কিন্তু মেডিকেল কলেজগুলোতে যারা স্ট্যান্ড করে তাদের মূল্যায়ন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতোই দেখা যায়। পদ্ধতিগত এসব দুর্বলতার কারণে আমরা মান ঠিক মতো পাচ্ছি না। তাই দেখা যায়, এখানে ইন্টার্নি করে শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে চলে যায়।

আন্ডারগ্র্যাজুয়েট নড়বড়ে হলে পোস্টগ্র্যাজুয়েট শক্তিশালী হবে না

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস (নিন্স) পরিচালক বলেন, ‘মেডিকেল শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো অ্যান্ডারগ্রেজুয়েট। এই স্টেইজের উপর যে চেয়ারটা বসবে সেটাই হচ্ছে পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল শিক্ষা। যদি স্টেইজটা নড়বড়ে হয়, তাহলে কিভাবে আপনি চেয়ারটা ঠিকভাবে বসাবেন। যতদিন আমরা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট মেডিকেলকে শক্তিশালি না করবো, ততদিন আমাদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শক্তিশালী হবে না।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মানের তুলনামূলক পার্থক্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে আট কোটি মানুষের জন্য মেডিকেল কলেজ আছে ২৩টা। বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য ১১৩টা। কিন্তু সব মেডিকেলে পড়ার মান সমান না। আমাদের কোয়ান্টিটি আছে, কোয়ালিটির দারুণ অভাব। আমাদের চিন্তা-ভাবনা হলো, চিকিৎসক বাড়াতে হবে। আমাদের আন্ডারগ্রেজুয়েট এবং পোস্টগ্র্যাজুয়েট সরকারই পরিচালনা করে। সরকারের ধারণা, ডাক্তার মানেই ফিজিশিয়ান, তারা শিক্ষক কিংবা গবেষক না। ডাক্তারকে কখনো জিজ্ঞাসা করা হয় না, তার কয়টা পাবলিকেশন আছে? মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জিজ্ঞেস করা হয় না আপনি কয়টা লেকচার নিয়েছেন, কয়টা অপারেশন করেছেন, কয়টা রিসার্চ করেছেন? কিন্তু প্রতিদিন ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, কেন রোগীটা ভর্তি হচ্ছে না, কেন অপারেশন করতে দেরি হচ্ছে, কেন রোগীর সঙ্গে ভালো মতো কথা বলা হলো না, কেন রোগীদের লাইন বড় হচ্ছে?’

মূল্যায়ন পদ্ধতির উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। আমাদের ফিডব্যাক সিস্টেম চালু করা উচিত। এটা খুবই সহজ, এতে ট্রেইনিদের প্রতি টিচারদের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। ভাবের আদান-প্রদানে আমাদের দুর্বলতাগুলো দূর করতে হবে। শিক্ষক, ফিজিশিয়ান ও গবেষকসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবার সাথেই যোগাযোগ থাকতে হবে। তা না হলে বিদেশের মূল্যায়নে আমরা আটকা পড়ে যাবো। দুর্ভাগ্যবশত ফ্যাকাল্টি পোস্টিং, ফ্যাকাল্টি এসেসমেন্ট করে মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্বশীলরা যদি উপলব্ধি করেন, কিভাবে ফ্যাকাল্টি পদায়ন দিতে হয়, কিভাবে প্রফেসর হবে, কোন বিষয়গুলোতে আমাদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে—এগুলো আমাদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সংযুক্ত করা যায়, তাহলে আমাদের চিন্তাধারার কিছু পরিবর্তন ঘটবে। একই সঙ্গে আমাদের ই-লকবুক দরকার, প্রত্যেকটি ইনস্টিটিউশনে ট্রেইনি মনিটরিং সেল দরকার। সর্বোপরি দায়িত্বশীল ব্যক্তি দরকার, যিনি আন্তরিকভাবে কাজ করবেন। তাহলে জাতিকে ভালো ডাক্তার উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।’

এতো শূন্যতার মাঝেও দেশের মেডিকেল শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক অর্জনও রয়েছে। আমাদের বিসিপিএস পরীক্ষা পরিবর্তন করেছে, এসেসমেন্ট সিস্টেম পরিবর্তন করেছে, আমাদের কারিকুলাম হালনাগাদ করেছি, লকবুককে আপডেট করেছি, ইনস্টিটিউশনাল মনিটরিং সেল আপডেট করেছি, এই চেষ্টা অব্যাহত আছে। আশা করছি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা ভালো কিছু দিতে পারবো।’

 

 

আপনার মতামত জানান