বঙ্গবন্ধু অনুপ্রেরণার বাতিঘর
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত যুগে যুগে এমন সব ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে, যাঁদের হাত ধরে রচিত হয়েছে মানবতার মুক্তির সনদ। তেমনই এক মুক্তির কারিগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর হাত ধরে আমরা পেয়েছি মুক্তির সুখ। পুরো জাতিকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র শোনালেন তিনি। ঘোষণা করলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব।’ তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ তাঁর তর্জনীর তীরে জেগে ওঠে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার মানচিত্র। আঙুলের ইশারায় পুরো জাতিকে এক করে বজ্রকণ্ঠের ঘোষণায় ছিনিয়ে আনলেন স্বাধীনতা। অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলার মানুষকে এনে দিলেন স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। এনে দিলেন বিশ্বের বুকে গর্বিত পরিচয়, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, জাতীয় সংগীত ও সংবিধান।
বঙ্গবন্ধু বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ আত্মনির্ভরশীল হবে। মানুষ দু’বেলা আহার পাবে। মাথার ওপর চাল থাকবে। তরুণ প্রজন্ম শিক্ষিত হবে। সব মানুষের কর্মসংস্থান ও সুস্বাস্থ্য থাকবে। সমাজে থাকবে সংহতি। এমন উন্নত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু করেন। তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশে ছিল না অবকাঠামো ব্যবস্থা। অর্থনীতির অবস্থাও ছিল করুণ। নতুন দেশে সমস্যার কোনো অন্ত ছিল না। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দৃঢ় পরিচালনায় একটি সুন্দর গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিল দেশ। মানুষের ভেতর উদ্দীপনা ছিল। সহনশীলতা ছিল। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ছিল। অসাম্প্রদায়িক চেতনাও ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে শত্রুরা, এদেশের নেপথ্যের কুশীলবরা পরাজিত হলেও বসে থাকেনি। তাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি তখনও। ষড়যন্ত্র ছিল আরও আগে থেকেই। পরিপূর্ণতা পায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কাক ডাকা ভোরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যসহ অনেককে হত্যা করে ঘাতকরা। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী, বাংলাদেশ বিরোধী দেশীয় বেঈমান ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের পরাজয়ের সুপরিকল্পিত জঘন্য ও কাপুরুষোচিত নির্মম প্রতিশোধ ছিল এ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ভাবতে অবাক লাগে, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন দেশে প্রাণ দিতে হলো? যে বুকে একদিন গড়ে উঠেছিল বাংলার মানচিত্র, সে বুকেই বুলেটের আঘাতে অঙ্কিত হলো রক্তের চিত্রকর্ম? এর চেয়ে মর্মপীড়াদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা ইতিহাসে আর কী হতে পারে? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম ট্রাজেডি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নেমে আসে বাঙালি জাতির জীবনে এক অন্ধকার অধ্যায়। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন-পরিচয়বিহীন এতিম, ভিক্ষুক দেশ। কলঙ্কিত হয় জাতি। লজ্জায় ডোবে মানবতা। বঙ্গবন্ধুকে কেন মাত্র অল্প সময়েই চলে যেতে হলো? বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন কেন এত বড় একটা আঘাত পেল? দেশের একজন রাষ্ট্রপতি হয়েও নিজের এবং পরিবারের কোনোরূপ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আগে থেকে তিনি নেননি কেন? এসব প্রশ্ন প্রজন্মের গবেষক ও বিশ্লেষকদের ভাবিত করে। ইতিহাস যেন আবার ঘুরে যায় পেছনের দিকে। সেই ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের বিষয়টিই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে। ‘আমি আমার দেশের মানুষদের একটু বেশিই ভালোবাসি। এটাই আমার দুর্বলতা।’ দেশের মানুষ অনুধাবন করতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করে দেশে পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী এবং সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী জুনিয়র সদস্য, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা মিলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধ্বংস করা এবং এ দেশকে বিশ্ব দরবারে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করে তোলা। ফলস্বরূপ মানুষ দীর্ঘদিন নিপীড়িত হয় উর্দিপরা, সাফারি পরা, মুখোশ পরা ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে। যারা মেকি গণতন্ত্রের নামে পকেটে পুরে নেয় পুরো দেশ। চেপে বসে স্বৈরশাসন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু নির্বাসনের পরিকল্পনা। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা পায়তারা করে। মনোজগৎ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরানোর চেষ্টা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। পাঠ্যপুস্তক, টিভির পর্দা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ তা বাজাতে দেওয়া হতো না।
ওরা ভেবেছিল ব্যক্তি মুজিবকে গণমানুষের কাছ থেকে আলাদা করলেই বুঝি নিভে যাবে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার প্রদীপ। ঘাতকরা বোঝেনি বাংলাদেশের প্রতিটি প্রাণ বুকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। অমিত আত্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রগতিশীল নেতৃত্ব, লালিত স্বপ্নের প্রতি অবিচল আস্থার নাম বঙ্গবন্ধু। যে আদর্শ ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে আগলে রেখেছিল বটবৃক্ষের মতো। ঘাতকরা সেদিন বোঝেনি ব্যক্তি মুজিবের মৃত্যু হলেও ‘বঙ্গবন্ধু’ নামক আদর্শের মৃত্যু হয় না। এত ষড়যন্ত্র করেও পারেনি হিমালয়সম শির উঁচু করা মানুষটিকে নির্মূল করতে। তাঁর স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলতে। আহমদ ছফা যথার্থই লিখেছেন, ‘একজন ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে; কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই।’ সত্যিই তাই। আজও বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু এক আদর্শের নাম। যাঁর জাদুর কাঠিতে বাংলা হয়েছে সোনাফলা দেশ। তাঁর ত্যাগ, আদর্শ, সততা, সাংগঠনিক দক্ষতা, ব্যক্তিত্বের মোহনীয়তা এতটাই জনপ্রিয় ছিল, ৭ মার্চের ভাষণ লাখ লাখ বাঙালি তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উজ্জীবিত করেছিল। তরুণ প্রজন্ম অন্যায়ে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস বঙ্গবন্ধু থেকেই পায়। তরুণ প্রজন্মের শক্তিকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে ঈর্ষণীয় অগ্রগতির মূলমন্ত্র শিখিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তরুণ প্রজন্মের চোখে অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও অনুপ্রেরণার বাতিঘর।
বঙ্গবন্ধু শুধু একটি শব্দ নয়। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সব থেকে সফল বাঙালি রাজনৈতিক নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু নন। বঙ্গবন্ধু সারাবিশ্বের মানুষের কাছে অনুকরণীয়। তিনি বিশ্ব নেতায় পরিণত হয়ে অভিহিত হয়েছেন বিশ্ববন্ধু হিসেবে। একজন নেতা বিশ্ব দরবারে তাঁর দেশের মানুষকে মর্যাদাপূর্ণ আত্মপরিচয়ের আলোকে কী অপরিসীম সাহসিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তার উজ্জ্বল উদাহরণ স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার দুঃখী মানুষের বন্ধু, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন বলেই আমরা এ স্বাধীনতা পেয়েছি। আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি যদি না জন্মাতেন আমরা আজও পাকিস্তানের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতাম। যাঁর ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের মানুষের গভীরতম প্রদেশকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই জাতির পিতাকে হারিয়ে আজ আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি তাঁর অভাব। বারবারই কানে প্রতিধ্বনিত হয় ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেতো, বঙ্গবন্ধু মরে নাই’।
বঙ্গবন্ধু শুধু দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেননি। বঙ্গোপসাগরের মত বিশাল স্বপ্ন ছিল তরুণ প্রজন্ম নিয়ে। তরুণ প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধ ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন এবং কীভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হয় তরুণ প্রজন্মকে তা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম কীভাবে হাত বলিষ্ঠ রাখবে তা শিখিয়ে গেছেন তিনি। তরুণ প্রজন্মকে সে প্রয়াস নিজের মতো করে নিতে বলেছেন। তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে শুধুই যে ভালোবাসে, তা কিন্তু নয়। তাঁর সংগ্রাম মুখর কর্মময় জীবন ও আদর্শ থেকে শিক্ষা নেয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনের আদর্শকে অনুসরণ করে। তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু একাধারে জীবনসংগ্রামের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক।
বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু, একুশ শতকে তাঁর সুযোগ্যকন্যা রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় এক উন্নয়নশীল, মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর অসীম সাহসিকতা, অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলি, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতায় দীক্ষিত তরুণ প্রজন্ম। আজকের তরুণ প্রজন্ম ডিজিটাল বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে নানা ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপি গৌরবময় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে অদম্য বাংলার এ তরুণ প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে জাতির পিতার হাতে গড়া এ স্বাধীন দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে তরুণ প্রজন্মকে আগামী দিনে আরও নিরলসভাবে কাজ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে সশরীরে উপস্থিত নেই। শহীদ বঙ্গবন্ধু মরেও অমর। বঙ্গবন্ধু না থেকেও বাংলাদেশের প্রতিটি ধুলিকণায়, আকাশে-বাতাসে, উন্নয়নের পরতে পরতে, সবখানে রয়েছেন। যতদিন পৃথিবী বেঁচে থাকবে, মানুষ বেঁচে থাকবে। যতদিন পৃথিবীর বুকে এবং বিশ্বের মানচিত্রে থাকবে বাংলাদেশ নামের আমাদের দেশ। ততদিন বঙ্গবন্ধু এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে, অমর হয়ে থাকবেন। বাংলার এ লড়াকু নেতা টিকে থাকবেন আগামী তরুণ প্রজন্মের মেধা, মনন ও আদর্শে। বঙ্গবন্ধু চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে, অস্তিত্বে, চেতনা আর অস্থিমজ্জায়। জাতির পিতার দেখানো পথ, আদর্শ ও স্বপ্ন, ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে যুগ যুগ ধরে দেশ থেকে দেশ-দেশান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ুক। অপরিমেয় শোকাহতচিত্তে এই দিনে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। প্রার্থনা করি, শহীদদের আত্মা চির শান্তিতে থাকুক।
– শেখ আনোয়ার , বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্রঃ জাগো নিউজ ২৪।
আপনার মতামত জানান