সুলাইমান (আ.)-এর বিস্ময়কর রাজত্ব
পবিত্র কোরআনে নবী সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্ব সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আর সুলাইমানের রাজ্যে শয়তানরা যা আবৃত্তি করত তারা তা অনুসরণ করেছে। আর সুলাইমান কুফরি করেনি; বরং শয়তানরাই কুফরি করেছিল। তারা মানুষকে শিক্ষা দিত জাদু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১০২)
আয়াতে উল্লিখিত ‘মুলকে সুলাইমান’ শব্দ যুগলের অর্থ ‘সুলাইমানের রাজ্য’।
সুলাইমানি রাজ্যের গোড়াপত্তন : নবী ইউশা ইবন নুন (আ.) যুদ্ধের মাধ্যমে আমালিকাদের পরাস্ত করে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। ইউশা (আ.) পবিত্র ভূমি বিজয় করার পর তথাকার ভূমি বনু ইসরাঈলের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন এবং তাদের পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার জন্য কাজি বা বিচারক নিযুক্ত করেছিলেন। এভাবে প্রায় সাড়ে তিন শ বছর কেটে যায়। এই দীর্ঘ সময়ে বনু ইসরাঈলে কোনো সম্রাট ছিল না। ফলে প্রতিবেশী সম্প্রদায়গুলো প্রায়ই তাদের ওপর আক্রমণ করত। এভাবে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে। আল-ইয়াসার মৃত্যুর পর মিসর ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত আমালিকা সম্প্রদায়ের জালুত নামক জনৈক অত্যাচারী সম্রাট বনু ইসরাঈলকে পরাজিত করে তাদের বস্তিগুলো দখল করে নেয়। পরে শামাবিল জন্মগ্রহণ করেন এবং শিক্ষাদীক্ষায় জাতির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি নবুয়ত লাভের পর বনু ইসরাঈল তার কাছে একজন সম্রাট নিযুক্তির দাবি জানায়, যার অধীনে থেকে যুদ্ধ করে তারা তাদের মাতৃভূমি পুনরুদ্ধার করতে পারে। তখন আল্লাহ তালুতকে তাদের সম্রাট মনোনীত করেন। জালুতের বিরুদ্ধে পরিচালিত সে যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন তালুত। দাউদ (আ.) সেই বাহিনীতে একজন সৈন্য ছিলেন। তিনি সম্মুখযুদ্ধে জালুতকে হত্য করে বনু ইসরাঈলের বিজয় ও মুক্তিকে নিশ্চিত করেন। এ যুদ্ধ জয়ের পর ‘তালুত রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে যা পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ২৪৬-২৪৮ আয়াতে বিধৃত হয়েছে।
সুলাইমানি পরিবারে রাজত্ব : তালুত সন্তুষ্ট হয়ে দাউদ (আ.)-কে রাজ্যের একাংশ দান করেন এবং আপন কন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দেন। এভাবেই দাউদ (আ.) রাজক্ষমতা লাভ করেন। সুরা সাবার ১০ নম্বর আয়াতে দাউদের (আ.) প্রতি জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, ইনসাফ, ন্যায়নিষ্ঠা, আল্লাহভীতি, বনু ইসরাঈলের আনুগত্য প্রভৃতি অসংখ্য অনুগ্রহসহ রাজক্ষমতা লাভের অনুগ্রহের ইঙ্গিত করা হয়েছে। কয়েক বছর পর বনু ইসরাঈলের সব গোত্র সর্বসম্মতভাবে তাঁকে নিজেদের শাসক নির্বাচিত করে এবং তিনি জেরুজালেম জয় করে ইসরায়েলি রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। তাঁর সাম্রাজ্যে অল্প সময়ের মধ্যেই শাম, ইরাক, ফিলিস্তিন এবং পূর্ব জর্দানের সমগ্র এলাকা অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে এ সাম্রাজ্য আকাবা উপসাগর থেকে ফুরাত অববাহিকার সমগ্র এলাকা, হিজাজ ও দামেস্কসহ এ সমগ্র অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। তবে সম্রাট হিসেবে দাউদ রাজকোষ থেকে কোনো বেতন-ভাতা গ্রহণ করতেন না। ব্যক্তিগত উপার্জন দ্বারা তিনি পরিবার পরিচালনা করতেন। (আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াইয়া, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইসলাম, ৫৪-৫৬)
সুলাইমানি রাজত্বের সময়কাল : পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে দাউদ (আ.)-কে লোহা ব্যবহারের ক্ষমতা দান করা হয়েছিল বলা হয়েছে। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে পৃথিবীতে লৌহ যুগ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১২ শ থেকে এবং এক হাজার অব্দের মাঝামাঝি সময়ে। আর এটিই ছিল দাউদ (আ.)-এর যুগ। প্রথমদিকে সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের হিত্তি (Hittites)) জাতি লোহা ব্যবহার করে। ২০০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত এ জাতির উত্থান দেখা যায়। তালুতের রাজত্বের আগে হিত্তি ও ফিলিস্তিনিরা বনু ইসরাঈলকে পরাজিত করে। ফিলিস্তিনের দক্ষিণে আদুম এলাকা আকরিক লোহায় (Iron Ore) সমৃদ্ধ ছিল। সম্প্রতি এই এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালানোর পর অনেক জায়গায় এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ পাওয়া গেছে, যেখানে লোহা গলানোর চুল্লি বসানো ছিল।
শাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ : নবী দাউদ (আ.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁরই পুত্র সুলাইমান (আ.) ওই সাম্রাজ্যের দায়িত্ব লাভ করেন। তাঁর রাজত্বকাল ৯৫০ খ্রিস্টপূর্ব ছিল বলে মনে করা হয়। পিতা দাউদ (আ.)-এর সাম্রাজ্যের সীমানা তিনি আরো বিস্তৃত করেন। পবিত্র কোরআনে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি উল্লেখ করতে ‘মাশারিকাল আরদ ওয়া মাগারিবিহা’ তথা পৃথিবীর পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল বোঝানো হয়েছে।
বরকতময় ভূমির সম্রাট : পবিত্র কোরআনে (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮১) সুলাইমানের অধীন ভূমিকে বরকতময় অঞ্চল হিসেবে বিধৃত করেছে। ব্যাখ্যাকাররা তা শামের (সিরিয়া) পবিত্র ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফলে উত্তরদিকে প্রাচীন ‘ইন্তাকিয়া’ কিংবা বর্তমান এশিয়া মাইনর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকতে পারে সুলাইমান (আ.)-এর রাজ্য। দক্ষিণের সীমান্ত সম্ভবত সৌদি আরবের তায়েফ এলাকার ‘ওয়াদি সুলাইমান’ নামক পাহাড়। কোনো কোনো ব্যাখ্যাকার যাকে কোরআনে উল্লিখিত ‘ওয়াদি আন-নামল’ বা ‘পিঁপড়ার উপত্যকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য আরো দক্ষিণে অবস্থিত সাবার রানি বিলকিসের অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত হলে সুলাইমান (আ.) এ রাজ্যের দক্ষিণ সীমানা বর্তমান ইয়ামেন পর্যন্ত বিস্তৃত।
সুলাইমান (আ.)-এর বিস্ময়কর রাজত্ব : সুলাইমান (আ.) এ বিস্তৃত সাম্রাজ্যে চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর সাম্র্রাজ্যকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাম্র্রাজ্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মানব, দানব, জিন, পশু-পাখি সব কিছুর ওপর তাঁর আধিপত্য ছিল। (সুরা নামল, আয়াত : ১৭; সুরা ছোয়াদ, আয়াত : ৩৭-৩৮)। জিনদের সাহায্যে তিনি অসাধারণ শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যের উদ্ভাবন করেন। (সুরা সাবা, আয়াত : ১২-১৩) আল্লাহর নির্দেশে বাতাস তাঁর বশীভূত ছিল। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮১)
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি জিনদের সাহায্যে বিরাট বিরাট স্থাপত্য কর্ম গড়ে তুলেছিলেন। লৌহের পাশাপাশি তিনি তামাকে শিল্পকর্মে ব্যবহার করতেন। পিতা দাউদকে (আ.) লৌহ গলানোর মুজিজা ও পুত্র সুলাইমানকে তামা গলিয়ে ধাতু তৈরির মুজিজা প্রদান করা হয়। (তাফসিরে কুরতুবি)
নির্মোহ সম্রাট : এত বিশাল ক্ষমতা ও প্রাচুর্যপূর্ণ সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও তিনি রাজকোষ থেকে কোনো ভাতা-বেতন গ্রহণ করতেন না। টুকরি বানিয়ে তা বিক্রি করে তার উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর রাজ্যের ন্যায়বিচার লোককথা হয়ে সারা দুনিয়ায় আজও মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হয়। জিনদের মাধ্যমে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ তাঁর অমর কীর্তি। কোরআনে বিধৃত তাঁর ইন্তেকালের দৃশ্য খুব-ই বিস্ময়কর। (সুরা সাবা, আয়াত : ১৪)
তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর ছেলে রাহবিয়াস সাম্রাজ্যের অধিপতি হন।
সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ।
আপনার মতামত জানান