ই-বাণিজ্যে নয়ছয়ের কারণে ক্রেতার আস্থা তলানিতে
অফারের নাম ‘সাইক্লোন’। এক হাজার ৭০০ টাকার জ্যাকেট ৫০ শতাংশ ছাড় পেয়ে লুফে নেন রাফি ইমন। এক মাসের অপেক্ষায় পণ্যটি হাতে পান। কিন্তু প্যাকেট খুলে মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না! রাফির ভাষ্য, ‘দেরিতে পাব জানি; কিন্তু জেনুইন পণ্যটি তো আশা করতেই পারি। অফারের অর্ধেক দামে ৮৫০ টাকায় যা পেয়েছি, মনে হচ্ছে ফুটপাতে বা ভ্যানে ৩০০ টাকায়ও এর চেয়ে ভালো মানের জ্যাকেট পাওয়া যায়।’
অন্যদিকে ইভ্যালিতে বড় অঙ্কের অর্থ লগ্নি করে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন রাজধানীর স্টেডিয়াম মার্কেটের টেলিভিশন ব্যবসায়ী সোহেল হাসান। একসময় বিভিন্ন কম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করতেন। লাভ হতো কমিশন হারে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ঝুঁকে পড়েন ইভ্যালিতে। প্রথম দিকে প্রতি ক্রয়াদেশে পাঁচ থেকে ১০টি টেলিভিশন ছিল। আগের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ কম দামে কিনে বেচতেন বাজারদরে। লাভ হতো অনেক। অবস্থা বুঝে তিনি শতভাগ ইভ্যালিনির্ভর হয়ে যান। কোপা আমেরিকা ও ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ খেলাকে কেন্দ্র করে বাজারে চাহিদা বাড়বে—এ ধারণায় গত এপ্রিলে বিশাল অঙ্কের ছাড়ে প্রায় ২০০টি টেলিভিশন অর্ডার দেন। অগ্রিম প্রায় ৫০ লাখ টাকা জমাও দেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে টেলিভিশন পাওয়ার কথা; এখনো পাননি। আটকে আছে লগ্নি করা টাকাও। অনেকবার যোগাযোগ করেও এর সমাধান পাননি সোহেল। এর মধ্যে ইভ্যালিতে আরো অনেকের টাকা আটকে থাকার খবর শুনে সোহেলের ঘুমই হারাম।
অনলাইনে পণ্য কিনে ঠকছে এমন অগণিত ভোক্তা। কেউ কেউ মাসের পর মাস পণ্যই পায়নি। যারা পায় তাদের অনেকের পণ্য অর্ডারের সঙ্গে মেলে না। বহু ভোক্তা ব্যবসায়ীও বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ লগ্নি করে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং সম্প্রতি কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মানুষের গৃহবন্দিত্বে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নামে-বেনামে ই-কমার্স সাইট।
ই-প্ল্যাটফর্মই এখন প্রশ্নবিদ্ধ : সময় এখন ই-বাণিজ্যের। কিন্তু কিছু প্রতারকের খপ্পরে পড়ে গোটা প্ল্যাটফর্মই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বহু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন, ফেসবুক পেইজ খুলে প্রতারণার কল বসিয়েছে অনেকে। চটকদার বিজ্ঞাপন, চোখ-ধাঁধানো অফার, আর মাতোয়ারা ছবিতে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে পাঠানো হয় যাচ্ছেতাই পণ্য। আবার অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য না পাঠিয়ে গ্রাহককে ব্লক করে দেওয়ার মতো ঘটনাও কম নয়।
তথ্য অনুযায়ী, দেশে ই-কমার্সের বাজার গত বছর পাঁচেক ধরে বিকশিত হচ্ছে। গত তিন বছর ধরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে খাতটি। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে গত বছরের মার্চে সাধারণ ছুটি শুরু হলে ই-বাণিজ্য তুঙ্গে ওঠে। বর্তমানে অনলাইনে অন্তত এক হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠান সক্রিয়। প্রায় সব ধরনের পণ্যই কেনাবেচা হচ্ছে এখানে। জার্মানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, যা চলতি বছর দুই বিলিয়ন এবং ২০২৩ সালে তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে ইভ্যালিসহ অনলাইনভিত্তিক অনেক ব্যবসায়ীর প্রতারণার বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। প্রতারণা ঠেকাতে তৎপর হয়েছে দায়িত্বশীল বিভিন্ন সংস্থা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেন, অনলাইন ব্যবসার মধ্যে ইভ্যালির বিষয়টি বর্তমানে আলোচনায় আছে। এই প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করেছে কি না, সেটি পুলিশ গুরুত্বসহকারে তদন্ত করবে। এ বিষয়ে মামলা হওয়ার কথা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, অনলাইন ব্যবসায় বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। শুধু কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম নয়, বিশ্বের নামকরা ই-কমার্সভিত্তিক অন্যান্য মার্কেটপ্লেসেও বিনিয়োগের নামে প্রতারণা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ডোমেইন কেনা, ওয়েবসাইট বানানোর নামে প্রযুক্তিতে দক্ষ এক শ্রেণির প্রতারক হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি টাকা। সম্প্রতি এ চক্রের মূল হোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আদর্শ মার্টের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, ঘরের শোভাবর্ধনসামগ্রী, দামি আসবাব থেকে শুরু করে পরিধেয় বস্ত্র, গৃহস্থালির হাঁড়ি-পাতিল, আলু-পটোল তরিতরকারি সবই মেলে এখানে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনে ঠকেছে অনেক ভোক্তা। বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা অনেক ই-কমার্স সাইট প্রতারণা করে যাচ্ছে। তবে অভিযোগের শীর্ষে ইভ্যালি।
লগ্নি করে ‘ধরা’ দুই ডজন শীর্ষ ব্যবসায়ী : ইভ্যালির ফাঁদে পড়া অন্তত দুই ডজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর পাওনা প্রায় দেড় শ কোটি টাকা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক থেকে সদস্যরাও। নিজেদের পাওনা টাকা আদায়ে তাঁরা কয়েক দিন ধরে ইভ্যালির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ গতকাল শনিবার দুপুরেও ইভ্যালির ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে বসেছিলেন শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তবে কোনো রকম ইতিবাচক ফল ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়েছে।
গতকালের বৈঠকে অংশ নেওয়া শীর্ষ এক ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআই পরিচালক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘ইভ্যালির কাছে পাওনা ও বিনিয়োগের বড় অংশই হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ইভ্যালিতে শুধু গ্রাহকই নয়, আমরা অনেক ব্যবসায়ীও প্রতারিত হয়েছি। ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছি আমরা বেশি। কয়েক দিন ধরে আমরা দফায় দফায় বৈঠক করছি। কিন্তু যাদের থেকে পণ্য কিনেছে তাদের টাকা, আবার যাদের থেকে টাকা নিয়েছে পণ্য দেবে বলে কোনোটাই করতে পারছে না ইভ্যালি। আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
জানা গেছে, ইভ্যালি শীর্ষ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পণ্য কিনে গ্রাহকদের সরবরাহ করত। ব্যবসায়ীদের থেকে পণ্য কিনতে গিয়ে ধীরে ধীরে বিপুল অঙ্কের বকেয়া পড়ে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ী ইভ্যালির নানা লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে নির্দিষ্ট সময় পরে কম দামে পণ্য পেতে বিনিয়োগ করে রেখেছে। এই বিনিয়োগ টেলিভিশন ও মোটরসাইকেল খাতে সবচেয়ে বেশি।
নীতিমালা মানে না ইভ্যালি : প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ না করার অভিযোগও উঠেছে। কেউ ক্রয়াদেশ বাতিল করলে তার অর্থ ফেরতদানের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। পণ্য ফেরতে গ্রাহকের পরিশোধিত মূল্য অপেক্ষা অধিক পরিমাণে অর্থ ফেরত প্রদানের বিষয়টিও বিভিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। এসব কারণে বিভিন্ন উচ্চমূলের পণ্য যেমন : হোম অ্যাপ্লায়েন্স, মোটরসাইকেল, গাড়ি ইত্যাদির ক্ষেত্রে এক শ্রেণির গ্রাহক বেশি অর্থ ফেরত পাওয়ার আশায় ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে অর্থ লগ্নি করছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনটিও রয়েছে। সেই প্রতিবেদনকে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস ধরে আমরা বিশ্লেষণ করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইভ্যালির যে দেনা রয়েছে, সেখান থেকে গ্রাহকদের কিভাবে নিরাপদে বের করে আনা যায়, সেটাই এখন মুখ্য বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘ইভ্যালির বিরুদ্ধে আমরাই প্রথম মামলা করেছিলাম। তারা একটি ‘ঈদ ধামাকা অফার’ দিয়েছিল। এ অফারটি ছিল প্রতিযোগিতা আইনের পরিপন্থী। সেই মামলা এখনো আমরা তদন্ত করছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগও চলতি সপ্তাহে তদন্ত শুরু হবে। প্রয়োজনে ইভ্যালির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডাকা হবে।’
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার অনুসন্ধানী সেলকে বলেন, ‘ইভ্যালির ব্যবসা শুরুই হয়েছিল মিসম্যানেজমেন্ট দিয়ে। এত বড় আকারের ব্যবসা করতে হলে একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট মার্কেটিং, মার্কেট স্ট্যাটিস্টিকস, বিজনেসসহ সব বিভাগে যে সেটআপ থাকার কথা সেটা ইভ্যালিতে আমরা পাইনি। ভোক্তারা ই-কমার্স বিজনেসের ক্ষেত্রে ঠকে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য দেশে আইনও আছে। ইভ্যালি সে আইন না মেনেই ব্যবসা করেছে।’ তিনি বলেন, এখন ইভ্যালি যে অবস্থায় চলে গেছে, তাতে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ভোক্তাদের টাকা ফেরত দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যদিও এ ক্ষেত্রে টাকা কতটুকু পাওয়া যাবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে।’ অফারের ফাঁদে পা না দেওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলবেন না। দেশে ই-কমার্স ব্যবসায় আইন আছে। আইনের বাইরে গিয়ে যারা ব্যবসা করবে, সেখানে ঝুঁকিও থাকবে, এটি মাথায় রাখা উচিত।’
ক্রেতাদের যত অভিজ্ঞতা : গত বছরের ১৭ অক্টোবর ইভ্যালিতে একটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেন কনফিডেন্স গ্রুপের কর্মকর্তা আবদুস সাত্তার। দুই লাখ ৮৮ হাজার টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেন। চার মাসেও বাইক না পেয়ে ভোক্তা অধিকারে মামলা করেন তিনি। সাত্তার জানান, অনেক চেষ্টার পরে তিনি মূল টাকা উদ্ধার করতে পেরেছেন। সাঈদ ইবনে তালহা নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘নির্ধারিত ৪৫ কর্মদিবসের অর্ডার এখনো হাতে পাইনি। এর মধ্যেও তারা নানা রকমের অফার দিয়ে অর্ডার নিয়েই যাচ্ছে। এগুলো কিভাবে ডেলিভারি দেবে? ইভ্যালি আসলে করছেটা কী।’ ডুয়েট শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুটি টি-শার্ট অর্ডার করেছিলাম। তিন মাস পর পেয়েছি, তা-ও একটি।’ ইভ্যালির মাধ্যমে রেয়ন ট্রেডার্স থেকে গেজেটস পণ্য কিনে ধরা খেয়েছেন অনেকে। অর্ডার এক, পেয়েছেন আরেক, যা পেয়েছেন তাতেও নানা সমস্যা। অল্পতেই বিকল হয়ে যাচ্ছে। বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের নম্বরে কল দিয়ে অভিযোগ জানালে জবাব আসে, ‘আপনি ভুল নম্বরে কল করেছেন।’
মাসুদুল হাসান নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘অর্ডার দিয়েছিলাম ভিশনের মশা মারার ব্যাট। প্রায় চার মাস পর সেলার কল করে জানায়, এটি তাদের স্টকে নেই। এর পরিবর্তে হিটের ব্যাট দিবে। অগত্যা তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। পণ্যটি হাতে পেয়ে দেখি অবস্থা খুবই খারাপ। বাটন খোলা, কাজ করে না।’
সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ।
আপনার মতামত জানান