প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে কোরআনের আলোকে ব্যাখ্যা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো এক ধরনের প্রাকৃতিক ঘটনা, যাতে মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়ে থাকে। অনেকের মতে, এটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবেই ঘটে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কাজ-কর্মের প্রভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে। তবে পবিত্র কোরআন এর ব্যাখ্যা ভিন্নভাবে করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সাগরে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে তিনি তাদের তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রোম, আয়াত : ৪১)
অর্থাৎ স্থলে, জলে তথা সারা বিশ্বে মানুষের নাফরমানির বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। বিপর্যয় অনেক রকমের হতে পারে। যেমন—দুর্ভিক্ষ, মহামারি, অগ্নিকাণ্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলির প্রাচুর্য, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি আপদ-বিপদ বোঝানো হয়েছে। (কুরতুবি, বাগভি)
নিম্নে এমন কিছু দুর্যোগের কোরআনি ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো—
ঝড়, অতিবৃষ্টি ও ভূমিধস : পৃথিবীর মহাদুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ঝড়, অতিবৃষ্টি ও ভূমিধস। মানুষের নাফরমানি ও কুফরির কারণে কখনো কখনো মহান আল্লাহ তাদের এসব দুর্যোগ দিয়ে সতর্ক করেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তোমাদের সাগরে বিপদ স্পর্শ করে, তখন তিনি ছাড়া যাদের তোমরা ডাক, তারা (তোমাদের মন থেকে) হারিয়ে যায়; অতঃপর তিনি যখন তোমাদের রক্ষা করে স্থলে আনেন, তখন তোমরা বিমুখ হয়ে যাও। আর মানুষ তো খুব অকৃতজ্ঞ। তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গিয়েছ যে তিনি তোমাদেরসহ স্থলের কোনো দিক ধসিয়ে দেবেন না অথবা তোমাদের ওপর শিলা বর্ষণকারী বাতাস প্রেরণ করবেন না? তারপর তোমরা তোমাদের জন্য কোনো কর্মবিধায়ক পাবে না। অথবা তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গিয়েছ যে তিনি তোমাদের আরেকবার সমুদ্রে ফিরিয়ে নেবেন না, অতঃপর তোমাদের ওপর প্রচণ্ড বাতাস পাঠাবেন না এবং তোমাদের ডুবিয়ে দেবেন না, তোমরা কুফরি করার কারণে? তারপর তোমরা আমার বিরুদ্ধে এ বিষয়ে কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৬৭-৬৯)
বজ্র বিদ্যুৎসহ ঝড়-বৃষ্টি : বজ্রপাত আল্লাহ তাআলার শক্তির নিদর্শনগুলোর একটি, যা তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাবধান করার জন্য রেখেছেন। তিনি চাইলেই যে কাউকে এর মাধ্যমে যেকোনো সময় শাস্তি দিতে পারেন। যদিও সব ক্ষেত্রে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা এমনটি করেন না। যা আল্লাহ তাআলা নিজেই পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘বজ্র তাঁরই তাসবিহ ও হামদ জ্ঞাপন করে এবং তাঁর ভয়ে ফেরেশতারাও (তাসবিহরত আছে)। তিনিই গর্জমান বিজলি পাঠান, তারপর যার ওপর ইচ্ছা একে বিপদরূপে পতিত করেন। আর তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) অবস্থা এই যে তারা আল্লাহ সম্পর্কেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তাঁর শক্তি অতি প্রচণ্ড।’ (সুরা রাদ, আয়াত : ১৩)
মানুষের কাজকর্মই বজ্রপাতের মূল কারণ। খোদাদ্রোহিতা, জেনা, ব্যভিচার, পরকীয়া, অন্যায়-অত্যাচার দুনিয়ায় যত বাড়বে, ততই দুনিয়ার বুকে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ বাড়বে।
জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা : নুহ (আ.) তাদের আল্লাহর সঙ্গে নাফরমানি ও তাঁর সঙ্গে অন্য কিছুকে শরিক করার শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তবু তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি। অবশেষে আল্লাহর আজাব আসে। এক ভয়ংকর প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস তাঁর জাতির অবাধ্য লোকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমন প্লাবন সেই জাতিকে গ্রাস করেছিল, যেই প্লাবন হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে আছে। তখন নুহ (আ.)-এর নৌকায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই রক্ষা পেয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার (নুহের) বংশধরদের অবশিষ্ট রেখেছি বংশপরম্পরায়।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ৭৭)
ভূমিকম্প : মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘বলে দাও, আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৬৫)
তাফসিরবিদদের মতে এর ব্যাখ্যা হলো ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের প্রকৃত রূপ কতটা ভয়াবহ, সে বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে জমিন, এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে পর্বতমালা, অতঃপর তা পর্যবসিত হবে উিক্ষপ্ত ধূলিকণায়।’ (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত : ৪-৬)
তা ছাড়া মহান আল্লাহ ভূমিকম্পের মাধ্যমেই কিয়ামত সংঘটিত করবেন। এ ব্যাপারে কোরআনে সুরা যিলযাল নামে পূর্ণাঙ্গ একটি সুরা অবতীর্ণ করেছেন।
খরা : অনাবৃষ্টি ও খরার মূল কারণও আল্লাহর নাফরমানি। আল্লাহর নাফরমানির কারণে কখনো কখনো অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। পবিত্র কোরআনে এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর বলেছি, তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয় তিনি মহাক্ষমাশীল, তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন…।’ (সুরা নুহ, আয়াত : ১০-১১)
অর্থাৎ মানুষ যখন তার নাফরমানি থেকে ফিরে আসবে, মহান আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিয়ে দুর্যোগ থেকে নিস্তার দেবেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের প্রবল পরাক্রমশালী প্রভু বলেছেন, যদি আমার বান্দারা আমার বিধান মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম, সকালবেলায় সূর্য দিতাম এবং কখনো তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৭০৮)
আমাদের উচিত, সব ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা করা। মহান আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করুন। আমিন।
সূত্রঃ কালেরকন্ঠ
আপনার মতামত জানান