ফিলিস্তিনি পরিবারে ইফতার করে ব্রিটিশ সাংবাদিকের ইসলামগ্রহণ
ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা লরেন বুথ পেশায় একজন মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক। প্রথম জীবনে তিনি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন। লরেন বুথ ১৯৬৭ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চল সফর করেন এবং ইসলাম ও মুসলমানের অনুরাগী হন।
ফিলিস্তিনিদের নৈতিক সমর্থন : একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে ফিলিস্তিন ও গাজা অঞ্চলের অমানবিক পরিস্থিতি লরেন বুথকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক আগ্রাসনের তীব্র বিরোধী ছিলেন তিনি। গাজা অবরোধের বিরাধিতা ছাড়াও আরব সংশ্লিষ্ট বিশেষত ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইউরোপীয় আচরণের কড়া সমালোচক ছিলেন তিনি। এমনকি ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিরোধিতায়ও তিনি কার্পণ্য করেননি। ফিলিস্তিনিদের অধিকার বিষয়ে বুথের দৃঢ় অবস্থানের কারণে ২০০৮ সালে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি ইসমাইল হানিয়া তাঁকে ফিলিস্তিনের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। ২০১০ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে খবরটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়।
সাংবাদিকতার জীবন : ১৯৯৭ সালে লন্ডন ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার জীবন শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। নিউ স্ট্যাটসম্যান, দ্য মেইল অন সানডে, আইটিভি, যুক্তরাজ্যের ইসলাম চ্যানেল, ইরানের প্রেস টিভি, ব্রিটিশ মুসলিম টিভি ও দোহার আল জাজিরাসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি কাজ করেন।
ফিলিস্তিনি পরিবারে ইফতারের আমন্ত্রণ : নিজের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে লরেন বুথ বলেন, এক ফিলিস্তিনি পরিবার তাঁকে ইফতারের দাওয়াত দেয়। পরিবারটি খুবই দরিদ্র ও অসহায়। এমনকি তাদের কাছে ওই দিনের খাবারও ছিল না। কিন্তু ওই ঘরের নারীর অন্তরজুড়ে ছিল উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা। ফিলিস্তিনি নারী আমাকে তাঁর ঘরে এমনভাবে সংবর্ধনা জানান যেন তিনি গাজা উপত্যাকার কোনো গলিতে নয়, বরং আমাকে তিনি তাজমহলে প্রবেশের সংবর্ধনা দিচ্ছেন। অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল মুখে তিনি আমাকে বলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
তীব্র গরমে অসহায় নারীর রোজা : আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, রাফা এলাকায় সামান্য খাবারে কেমন রমজান কাটাচ্ছেন? তিনি হাসিমুখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলেন। আমি তাঁবুর ভেতর বসে খাওয়া শুরু করি। ঘরে থাকা সামান্য রুটি ও হুমমাস খাওয়া শুরু করি। মনে মনে আমার খুবই রাগ হয়। এ কেমন সৃষ্টিকর্তা, যিনি ক্ষুধার্তদের আরো ক্ষুধার্ত হতে বলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যও রোজার বিধান করেছেন! তখন গ্রীষ্মকাল ছিল। প্রচণ্ড গরম পড়ছিল। আমি বললাম, আপনাকে সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়ে আমি জিজ্ঞেস করব, তোমার সৃষ্টিকর্তা রোজার নির্দেশ কেন দিয়েছেন? তুমি কেন রমজানে রোজা রাখো?
দরিদ্রদের স্মরণে রোজা রাখেন তাঁরা : আমার কথা শুনে ওই নারী কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। এরপর দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, বোন, আমরা দরিদ্রদের কথা স্মরণ করতে রমজানের রোজা রাখি। তাঁর কথা আমার অন্তরের গভীরে টোকা দেয়। সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় এবং চোখ অশ্রুসজল হয়। আমি ভাবতে থাকি যে ইসলাম অনেকের ভাবনাকে অনেক বড় করে তোলে। তখন পর্যন্ত আমার সঙ্গে ইসলামের গভীর কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ অনেকে ইসলামকে হৃদয়ের গভীর থেকে অনুভব করে। অনেক আগ থেকেই আমি ফিলিস্তিনিদের ভালোবাসতাম। তবে এর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক ছিল না।
ইরানের মসজিদে রাত্রি যাপন : পরের বছর আমি সাংবাদিক হিসেবে ইরানে যাই। সেখানকার প্রশিদ্ধ বিবি ফাতেমা মসজিদ নামের একটি মসজিদ পরিদর্শন করি। আগে থেকেই অজু করতে জানতাম। অজু করে একটি চাদর গায়ে দিই এবং মহান ‘আল্লাহ’র নাম উচ্চারণ করি। আল্লাহর প্রার্থনা করি। আল্লাহ আমাকে নতুন কিছু দেবে না। আমার সব কিছু আছে। এই ভ্রমণের সুযোগ দেওয়ায় তোমাকে ধন্যবাদ। তবে তুমি ফিলিস্তিনের মানুষের কথা ভুলো না। ওই রাত আমি অনেকের সঙ্গে মসজিদে কাটিয়ে দিই। ফজর নামাজ পড়ে বের হয়ে নতুন সূর্য অবলোকন করি। তখন আমার মাথায় কেবল ইসলামের কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল।
বিমানে ইরানি নারীদের বেদনাদায়ক দৃশ্য : লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করি। আমার মনে হচ্ছিল, বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। লন্ডনে পৌঁছার সাত দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে আমি কলেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করি। বিমান লন্ডনের আকাশে উড়াল দিতেই ইরানি নারীরা নিজেদের পুরো হিজাব খুলে ফেলে। সবাই প্রায় নগ্ন হয়ে পড়ে। আল্লাহর অনুগ্রহে তখন থেকে অদ্যবধি হিজাব পরে আছি। কিন্তু বিমানের ওই বেদনাদায়ক দৃশ্য আমার মধ্যে চরম হতাশাবোধ তৈরি করে।
মায়ের কাছে দুই মেয়ের তিন প্রশ্ন : ওই সময় আমার আট বছর ও ১০ বছরের দুই মেয়ে ছিল। মুসলিম হওয়ার পর তারা আমাকে তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, মুসলিম হওয়ার পরও আপনি কি মা হিসেবে থাকবেন? আমি বললাম, আমি আগের চেয়ে আরো উত্তম মা হব। তারা আনন্দিত হয়ে ফের জিজ্ঞেস করল, মা, আপনি কি মদ পান করবেন? আমি বললাম, মুসলিম হয়ে কখনো আমি মদ পান করব না। তাঁরা আনন্দিত হয়ে ফের প্রশ্ন করল, মুসলিম হয়ে আপনার বক্ষ কি উন্মুক্ত রাখবেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা এমন প্রশ্ন করলে কেন? তারা বলল, আপনার বক্ষ উন্মুক্ত রেখে আপনি যখন স্কুলে আসতেন, তখন আমরা খুবই লজ্জা বোধ করতাম। আমরা তা অপছন্দ করি এবং চাই আপনি আর এমন করবেন না। আমি বললাম, মুসলিম হওয়ার পর আমি পুরো দেহ ঢেকে রাখব। এ কথা শুনে তারা বলল, আমরাও ইসলাম ভালোবাসি। এরপর তাঁরাও আমার মুসলিম সঙ্গী বনে যায়।
মুসলিম নারীর জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় : লরেন বুথ এক সাক্ষাতকারে নিজ জীবনের কথা তুলে ধরে বলেন, মূলত তিনটি প্রশ্ন একজন মুসলিম নারীর জীবনে খুবই প্রাসঙ্গিক।
এক. আপনি সন্তানদের নিয়ে ঘরের প্রধান হতে চান কিনা? সহকর্মী, বন্ধু বা মদ্যশালায় সঙ্গীদের সময় না দিয়ে একজন মা হিসেবে পরিবারের সদস্যরা কি আপনার ওপর নির্ভর করতে পারে?
দুই. সার্বিক জীবনে আল্লাহর সব বিধি-নিষেধ কি আপনি পালন করছেন?
তিন. আপনি কি একজন সম্মানিত মুসলিম নারী হিসেবে জীবন যাপন করছেন?
মুসলিম হিসেবে জীবন যাপন করে আমি তীব্রভাবে উপলব্ধি করি, আপনার কোনো সমস্যা থাকলে আপনার বন্ধু বা পরিবারকে তা বলবেন না। বরং এর বদলে আপনি প্রতি রাতে পবিত্র কোরআন পাঠ করুন। অন্ততপক্ষে ১০ মিনিট করে পড়ুন। এতে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক হবে এবং বৈরিপরিবেশে থেকেও আপনার ঈমান সুদৃঢ় হবে। নতুবা আপনার ঈমান দুর্বল হতে থাকবে।
মুসলিমদের বাস্তব জীবন : মুসলিম হওয়ার আগে একজন মানুষকে তিনটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে হতে পারে। এক. আপনাকে মুসলিমভীতি অন্তর থেকে দূর করতে হবে। দুই. মুসলিমদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। তাদের জীবনাচার সচক্ষে দেখতে তাদের সঙ্গে মিশতে হবে। আমি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এ অভিজ্ঞতা লাভ করি। তিন. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনাকে প্রথমে একবারের জন্য হলেও মসজিদে যেতে হবে। একসঙ্গে মানুষের নামাজ আদায়ের অপূর্ব দৃশ্য একবারের জন্য হলেও অবলোকন করতে হবে।
সূত্র : ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকা ও দি সিয়াসাত ডেইলি
আপনার মতামত জানান