বাংলা নিয়ে গর্ব, বাংলা নিয়ে দুশ্চিন্তা
এড. জয়নুল আবেদীন :
‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছো বাঙ্গালী করে, মানুষ করোনি’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চৈতালি কাব্যের ৩৭ নম্বর কবিতা ‘বঙ্গমাতা’র অংশ। ‘বঙ্গমাতা’ কবিতাটি লেখা হয়েছিল ২৬ চৈত্র ১৩০২ বাংলা সনে। সময়ের পার্থক্য এখন ১২৫ বছর (১৪২৭-১৩০২)। ‘বঙ্গমাতা’ কবিতা লেখার সময়কালে কবিগুরু যে ‘সাত কোটি’ সন্তানের কথা বলেছিলেন, এখন তা কত কোটিতে উন্নীত হলো?
ভাষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট এথনোলগের ২০২০ সালের ২২তম সংস্করণের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ‘পৃথিবীজুড়ে মোট বাংলাভাষীর সংখ্যা ২৬ কোটি ৫০ লাখের কিছু বেশি। ভাষা গবেষকদের হিসেবে বিশ্বজুড়ে বাংলাভাষীর সংখ্যা ২৮ কোটির মতো। ২০২০ প্রকাশিত ঢাকা টাইমস-এর এক ফিচার প্রতিবেদনে জানা যায় ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ। এটা পরিসংখ্যানবিদদের হিসাব। তবে, এসব হিসাবকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির নানা তত্ত্ব ও আর সর্বশেষ তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে যে, ১২৫ বছরে বাঙালির সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধির কথা ছিল সেটা হয়েছে কি না।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে ডিসেম্বরের ছুটিতে চ্যাড্উইলহিথে ছিলাম। লন্ডনের চ্যাড্উইলহিথ বাঙালিবিরল এলাকা। দেশের অস্থির অবস্থা থেকে স্বস্তি পেতে বাঙালিবিরল এলাকাই খুঁজছিলাম। তখন আমার তিন মেয়েই লন্ডনে। রয়েছে তাদের সন্তান-সন্ততিও। প্রতি বইমেলার সময় অনেক টাকা খরচ করে ডিএইচএল-এ নাতি-নাতনিদের জন্য বই পাঠাই।
বই পাঠিয়ে দিয়েই ভাবতাম, নাতি-নাতনিরা এখন আমার বই পড়ছে আর আমাকে মনে করছে। কী আনন্দ! লন্ডনে পৌঁছানোর পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ভুল, সবই ভুল। ওখানে জন্ম নেওয়া নাতি-নাতনিরা আমাদের গ্রামবাংলার রংঢং কিছুই বোঝে না। বাংলায় লেখাপড়া করা দূরের কথা, নাম দস্তখতও জানে না। সারাক্ষণ টিভি গেইমসে মত্ত; আর হাসাহাসি ও খুনসুটি সবই ইংলিশে। হ্যারি পটারের বই গড়গড়িয়ে পড়তে পারে, লেখতে পারে ইংরেজি গল্প, চেনে না বাংলা বর্ণমালাও (!)। চিরতার পানি গেলানোর মতো অনেক সাধনা করে নাম দস্তখত শেখানোর চেষ্টা করি। তারা বাসার ভেতর বাবা-মায়ের মুখে শুনে শুনে যে বাংলা বলে সে বাংলা বাইরে ব্যবহারযোগ্য নয়। আমার মতে তারা উত্তরাধিকারসূত্রে বাঙালি হলেও বাংলাভাষী নয়।
লন্ডনের বাঙালিবিরল এলাকায় চার দেয়ালের ভেতরে দিন গোনার পালা শেষ হচ্ছিল না। কী এক অভাব জমে জমে বুক ভারী হতে চলছিল। খালাস করার জন্য বাঙালি দরকার। বাংলা কথা শোনা ও বাঙালির মুখদর্শনের জন্য চরম অস্থিরতার সময়টাতে পরিচয় হলো প্রবীর দত্ত গুপ্তের সঙ্গে। ওপার বাংলার মানুষ। বিশিষ্ট ভাষা গবেষক, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্বের প্রিন্সিপাল প্রবীর দত্ত গুপ্ত। ভাষাসহ নানা বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কিন্তু আমাদের কবিতা, উপন্যাস শতবর্ষ কেন, পঞ্চাশ নয়, দশ বছর পরেও কেউ পড়বে না। কারণ কী? বলেন, বাংলা কি কেউ আজকাল পড়ে নাকি? সবকিছু এখন অন্য কিছু, টেকনোলজি আর ইংরেজি এ দুটো জিনিস। এ দুটো জিনিস ছাড়া আর কিছুই টিকবে না। ’’
টেকনোলজি আর ইংরেজির সর্বগ্রাসী প্রসারসহ বাংলাভাষার হ-য-ব-র-ল অবস্থাই এর জন্য দায়ী। ‘পিউরিফিকেশন বলে একটা কথা আছে। নর্দমার জল যদি আপনাকে খেতেই হয় তো কীভাবে খাবেন? ফিটকিরি দিয়ে ছেঁকে ময়লা ফেলে ওপর থেকে নিলেই তো পিওর হয়। আমাদের ব্যাপারটা হলো পেটে অসুখ হলে হোক, খেয়ে নিলেই হলো। ভাষার বেলায়ও পিউরিফিকেশন যতদিন না হবে, আমি জানি না ওনারা ঐভাবে নেমেছেন কি না, ভাষাটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আগামী ২০/২৫ বছর পরে কিন্তু আর টিকে থাকবে না। দূষিত পানি পান করার মতো পরে ডায়রিয়া/ডিসেন্ট্রিতে ভুগতে ভুগতে একদিন মরেই যাবে।” এই আশঙ্কা প্রবীর দত্ত গুপ্তের। শিক্ষকদের ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তিনি প্রায়শই বাংলাদেশে আসেন বলে জানান। বাংলা ভাষা তলিয়ে যাওয়ার অসংখ্য কারণের মধ্যে তিনি কয়েকটা বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বলছিলেন এভাবে,
‘‘যে চিত্রটা আমাকে বাংলাদেশের কয়েকজন টিচার দিয়েছেন তা বড়ই দুঃখজনক। বলে দেখুন স্যার, ব্যাপারটা ঐযে, এখানে (স্কুলে) যারা বড় বড় ডোনেশন দিতে পারে তাদের ওয়াইফদের পোস্ট দিতে হয়। দেখা গেল কি, ওরা ল্যাংগুয়েজের টিচার ছিলেন না। কেমিস্ট্রিতে লেখাপড়া, বাংলা পড়ানো শুরু করে দেয়। সরকারি স্কুলগুলোর পরীক্ষায় পাস করলেই সরকারি কলেজের টিচার হওয়া যায়। করপোরেশনের অধীনেও রয়েছে স্বজনপ্রীতি, লেখাপড়ার মান অত্যন্ত নিম্নস্তরের। পশ্চিমবঙ্গেরও একই চিত্র। বলে কি ইংরেজি তুলে দাও। ঔপনিবেশিক ইংরেজি তুলে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কীভাবে তুলবেন? অরাজকতার কারণেই ইদানীং আপনার বাসার ছেলেমেয়েরা রোমান হরফে বাংলা লিখতে শুরু করে দিয়েছে। ইংরেজি ভাষা কত তরতর করে উঠে যাচ্ছে। আর এখনকার বাঙালিদের তো কথার মধ্যে অর্ধেক ইংরেজি না বললে হয়ই না। বাড়ির কাজের লোকেরা পর্যন্ত বলে, ‘আপনি ম্যানেজ করে নেবেন, কালকে আমার টাইম নাই’। আমরা বাংলা বলার সময় এভাবেই ইংরেজির ফুলঝুরি ছুটাই। কিন্তু ইংরেজি বলতে গেলে আর পারি না। এটা খুব দুঃখজনক যে, বঙ্গ ভাণ্ডারে বিবিধ রতন আছে, ওটা আহরণ কেউ করল না। ওটা থেকে ছিটকে সরে গিয়ে নিজেদের অপচয় করল বিচ্ছিন্নভাবে। এজন্য বাংলা লেখার পাঠক ক্রমশ কমে যাচ্ছে, মারাত্মক হারে। ’’
বাংলা সাহিত্যে অধ্যয়নকালে আমার কাছেও বিভীষিকা ছিল ধ্বনিতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব। ভাষা নির্ভুল করাসহ বিভীষিকা দূর করার জন্য প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে কিছু বই কিনি। কিনেছিলাম বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ ও। বইটির ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্ব অংশ রচনা করেছেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, রূপতত্ত্বের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক মাহবুবুল হক। অধ্যাপক পবিত্র সরকার প্রারম্ভিক অংশ ছাড়াও বাক্যতত্ত্ব, বাগর্থতত্ত্ব এবং ব্যঞ্জনাতত্ত্ব লিখেছেন।
ব্যাকরণ নিঃসন্দেহে মূল্যবান সম্পদ। বিশ্বের ৩০ কোটি বাংলাভাষী প্রতিদিন ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, বাগর্থতত্ত্ব ও ব্যঞ্জনাতত্ত্বের চেয়ে বেশি মুখোমুখি হয় বানানতত্ত্বের। ৩৭৬ পৃষ্ঠা গ্রন্থেও (৩২৭ থেকে ৩৩১) মাত্র ৫ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘নির্বাচিত বানানের নিয়ম’। এই ৫ পৃষ্ঠা পাঠ করলেই টের পাওয়া যায় ‘ণত্ববিধি’ আর ‘ষত্ববিধি’র দৌরাত্ম্য। টের পাই মগজ কীভাবে টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। চিকিৎসাশাস্ত্রের বই যে কারণে শুধু চিকিৎসকদের জন্য পাঠযোগ্য সে কারণে ‘প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ’ও মনে হয় শুধু ব্যাকরণবিদদের জন্য পাঠযোগ্য। সার কথা, হাঁটায় হাঁটায় রাস্তা হয়ে যাওয়া যত সহজ হাঁটার জন্য রাস্তা তৈরি করা ততই কঠিন।
স্কুলজীবন থেকেই ইংরেজিতে আমার নড়বড়ে অবস্থা। শিক্ষাকাল পর্যন্ত am, is are-এর গোলকধাঁধা থেকেই বের হতে পারিনি। ইংরেজির দুর্বলতার কারণে সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্য হওয়ার কথা ভাবতেই কাঁটা দিয়ে জ্বর আসে।
দেশের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য ১৯৮৭ সালে আইন প্রণীত হয়। আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের সরকারি অফিস-আদালতসহ সর্বত্র অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে, অন্য কোনো ভাষায় আবেদন-নিবেদন বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এত বছরেও সেটা হলো কই? বাংলা ভাষা নিয়ে এসব কথা ফেব্রুয়াতিই! ফেব্রুয়ারি শেষে, সবই তথৈবচ। ইংরেজির দাপটে আমার কাছে, সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্য হওয়া দূরের কথা নবিশের যোগ্যতা অর্জনও সম্ভব নয়।
নিজের দেশে আমার এই অবস্থা। অন্যদিকে, বিদেশে অবস্থানরত নাতি-নাতনিদের মুখ থেকে বাংলা ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। দেশে অবস্থানরত একমাত্র নাতিও পড়ে ইংলিশ স্কুলে। তিন বছরের নাতনি মোবাইল ও ডিশের কল্যাণে এখনই বাংলা বুলি ‘দাদা-দাদি’ ডাকের পরিবর্তে ‘গ্র্যান্ডপা-গ্র্যান্ডমা’ ডাকতে শুরু করেছে। পরবর্তী প্রজন্মের মুখে ইংরেজি বুলি ভর করতে দেখে এক সময় খুব খারাপ লাগত, এখন আর খারাপ লাগে না। কারণ, আমাদের মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাগজে-কলমে যেখানেই ঠাঁই করে নিক না কেন বাস্তবে দেশের চৌকাঠ পার হলেই অচল হয়ে পড়ে। পদে পদে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
একবার এয়ার ইন্ডিয়া বিমানযোগে লন্ডনের হিথ্রো থেকে দিল্লি অবতরণ করি। দীর্ঘসময় আকাশে থেকে দিল্লির মাটিতে পা রেখে মনে হয়েছিল বাড়িতে পৌঁছে গেছি। একটা সময়ে অবিভক্ত ভারত তো আমাদের বাড়িঘরই ছিল। ভুল ভাঙতে শুরু করে পদে পদে আটকে পড়তে দেখে। আদালত পাড়ায় ঘুরাঘুরি করে যেটুকু ইংরেজি রপ্ত করেছি সেটুকু মুখ থুবড়ে পড়ে দিল্লির বিমানবন্দরের জৌলুশ দেখেই। ঢাকাগামী বিমানে ওঠার প্রস্তুতিকালে লাগেজ আটকে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। পুলিশের হিন্দি-ইংরেজি মিশেল ভাষায় যতটুকু বুঝতে পারি ততটুকুর উত্তর আমার বাংলা-ইংরেজি মিশেল ভাষায় দেওয়ার চেষ্টা করি। পুলিশকে কিছুতেই সন্তুষ্ট করতে পারছি না যে, আমাদের লাগেজে কোনো বেআইনি মালামাল নেই, হিথ্রো পুলিশ স্ক্যান করার পরই আমাদের বিমানে উঠতে দিয়েছে। লাগেজসহ সপরিবার এক পাশে দাঁড় করিয়ে অপরাপর যাত্রীদের বিমানে ওঠার সুযোগ করে দেয় তারা। যাত্রীদের ওঠা শেষ। তা দেখে শীতের মাঝেও আমার চুলের গোড়া দিয়ে ঘাম বের হতে শুরু করে। বিমান ছেড়ে দেওয়ার সময় আসন্ন। দোভাষী হিসেবে ডাকা হয় পশ্চিমবঙ্গের এক যুবককে।
যুবক আমার কাছে জানতে চায় আপনার লাগেজে ইলেক্ট্রনিক গুডস আছে? ইলেক্ট্রনিক গুডস মানে? মানে, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, রেডিও, ল্যাপটপ ইত্যাদি। আমার মেয়ের ব্যবহৃত একটা পুরনো ল্যাপটপ আছে। দোভাষী পুলিশের সঙ্গে তাদের, ‘হোগিয়ে নোগিয়ে’ ভাষায় বাতচিৎ করার পর ওদের চিরায়ত ইন্ডিয়ান হাসি হেসে বিমানে ওঠার পথ দেখিয়ে দেয়।
লেখক আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]
সুত্র: দেশ রূপান্তর
আপনার মতামত জানান