বনায়নে প্রধানমন্ত্রীর অবদান

প্রকাশিত

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমঃ

বনায়নে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা দৃশ্যমান। বাংলাদেশে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে। মোট ভূমির প্রায় ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বনায়ন। যদিও পরিবেশ সংরক্ষণে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, দেশে বিদ্যমান বনায়নে প্রায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বনভূমি কম রয়েছে। পাহাড়ী, ম্যানগ্রোব ও শাল বন রক্ষণাবেক্ষণে বনবিভাগ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ওই বনবিভাগের ত্তত্বাবধানে প্রায় ১ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে যা বিদ্যমান বনায়নের প্রায় ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ১৯৭৩ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে জীববৈচিত্র ও পরিবেশ সংরক্ষণে ১৬ টি সংরক্ষিত বায়ো ইকোলোজিক্যাল জোন রয়েছে, যেখানে প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার ৬৭৫ হেক্টর বনভূমি রয়েছে। ওই সংরক্ষিত জোনের আওতায়, ৮ টি জাতীয় পার্ক, ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১ টি গেইম রিজার্ভ এরিয়া রয়েছে। বনবিভাগের ত্তত্বাবধান ছাড়াও সামাজিক, পারিবারিক, চা ও রাবার বাগানে প্রায় ১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি রয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, বনবিভাগের ত্তত্বাবধান ছাড়াও দেশে প্রায় অর্ধেক বনায়ন রয়েছে। যদিও বনবিভাগ, সংরক্ষিত এলাকায় বনায়নের সম্প্রসারণ ও রক্ষনাবেক্ষণ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। তবুও বনজ সম্পদ হ্রাসে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। যা হোক, বনবিভাগ কর্তৃক পরিবেশ সংরক্ষণে বনজ সম্পদের রক্ষনাবেক্ষণে আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাছাড়া সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন অংগ-সংগঠনও বনায়ন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ওই দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নের্তৃত্বাধীন বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ বনজসম্পদ রক্ষনাবেক্ষণে অবদান রেখে যাচ্ছে । সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের নের্তৃতে গঠিত “গ্রীণ এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্ট” সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ রোপন করে যাচ্ছে। আশ্চার্যজনক ব্যাপার হলো, ওই সংগঠনটি সারা বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব বিবেচনায় বৃক্ষ রোপনে উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে যাচ্ছে। সেমিনার ও ওয়ার্কসপেও উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন যে, গাছ জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে স্বাস্থ্য সম্মত জীবনযাপনে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে ওই সংগঠনের আওতায় সমগ্র বাংলাদেশে লাখ-লাখ বৃক্ষ রোপন হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে যে, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রায় এক কোটির বেশী বৃক্ষ রপোন করবেন যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন মডেলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

মোটা দাগে বলা যেতে পারে যে, ওইভাবে যদি কোন সংগঠনের আওতায় মানুষ প্রতিনিয়ত বৃক্ষ রোপন করে যায়, তাহলে সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধিতে পরিবেশ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ২৫ শতাংশ বনভূমিতে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় অবকাশ থাকে না। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের নির্দেশনায় দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকরী প্রতিষ্ঠানসমূহ গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে দেশে বিদ্যমান বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানও বনজ সম্পদ বৃদ্ধিতে অগ্রনী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। সরকারের পরিবেশ, বন, ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও পরিবেশ সংরক্ষণে বনজ সম্পদের রক্ষনাবেক্ষণ ও সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। অন্যদিকে গবেষকগণ, পরিবেশ সংরক্ষণে বনজ সম্পদ রক্ষানাবেক্ষণের ওপর গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন।

একদিকে মানুষের প্রয়োজনে যেমন বনায়নের গুরুত্ব রয়েছে, অন্যদিকে মানুষই প্রয়োজনে বনায়ন ধ্বংস করছে। যদিও বর্ধিত জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদার প্রয়োজনে বাসস্থান, আসবাবপত্র, খাদ্য, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও কল-কারখানা নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তবুও পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন বৃদ্ধি ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণের গুরুত্বও অপরিসীম। বাস্তবচিত্র বিশ্লেষনে দেখা যাচ্ছে যে, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, অনুমতি বিহীন বৃক্ষ কর্তণ ও সংরক্ষিত বনায়নের কৃষি জমিতে স্থানান্তর, পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের প্রার্দুভাব, নদী-নালা ভরাট, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও মাটি-পানি ও বায়ু দুষণে প্রতিনিয়ত বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে।

পরিবেশ সংরক্ষণে বিদ্যমান বাস্তব অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য সরকার, রাজনৈতিক দল ও গবেষকদের সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সেই দিকে দৃষ্টিপাত করলে, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পরিবেশ সংরক্ষণে গৃহীত বিজ্ঞান সম্মত পদক্ষেপের বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব-পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে ১ টি করে ফলজ, বনজ ও ঔষধীসহ কমপক্ষে তিনটি গাছ লাগানের আহবান জানিয়েছেন। তিনি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অফিস-আদালতের প্রাঙ্গণে বৃক্ষ রোপণের উদ্বাত্ত্ব আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, সবুজায়নের মাধ্যমেই পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব। তিনি আরও বলেছেন যে, তার সরকার দেশের মোট ভূমির কমপক্ষে ২০ শতাংশ বনভূমিতে উন্নীত করার লক্ষ্য স্থির করেছেন। তিনি জলাশয় ভরাটে নতুন স্থাপনা নির্মাণে নিরুৎসাহিত করে পরিবেশ সংরক্ষণে গাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার আহবানও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, খাল-বিল ও নদীর দুই পাশে রাস্তা নির্মাণে জলাধারের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাসহ পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে পরিবেশ দূষণ কমানোর ওপর অধ্যাদেশ চালু করেছিলেন। ওই অধ্যাদেশের আওতায় বনজ সম্পদ রক্ষনাবেক্ষণে জীববৈচিত্র সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, বনায়ন বৃদ্ধিতে জীব-বৈচিত্র রক্ষাসহ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। নতুবা বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মানুষের টিকসই জীবনযাপনকে প্রাধান্য দিয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সংরক্ষণে কর্মরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পরিবেশ পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার ও প্রধান মন্ত্রী জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোব বনায়ন সুন্দরবনকে লবনাক্ততার প্রাদুর্ভাব হতে রক্ষা করার আহবান জানিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নের্তৃতে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে গাছ লাগানোর আহবান জানিয়েছেন। পরিবেশের বিপর্যয় মোকাবেলায় শেখ হাসিনা সরকারের নের্তৃত্বে সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধিতে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হচ্ছে। পরিসংখ্যানগত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধিতে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬০১ জন মানুষ অর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ওই প্রণোদনার আওতায় ৩৫৬ কোটি ৮২ লাখ ৩৪ হাজার ৫২২ টাকা মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পরিবেশ সংরক্ষণে আবদান রাখায় জাতিসংঘ কর্তৃক ২০১৫ সালে “চ্যাম্পিয়ন্স অব্ দি আর্থ” পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বনায়ণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ভূমিকা রাখায় বাংলাদেশ “সাউথ এশিয়া কো-অপারেটিভ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের” নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে। যদিও প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপায়ে বনায়ণ হ্রাস পাচ্ছে। তুবও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিদ্যমান বনায়ন রক্ষানাবেক্ষণসহ প্রতিনিয়ত বৃক্ষরোপণের ওপর গুরুত্বারোপ করে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুজিববর্ষ উদযাপনে ১০ মিলিয়ন গাছ লাগানোর লক্ষ্যে সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিতরণ করে যাচ্ছেন। মোটা দাগে বলা যেতে পারে যে, বৃক্ষ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যেতে পারে না। ওই হিসেবে, স্বাস্থ্য সম্মত জীবন যাপনে দেশে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। ফলশ্রুতিতে, বনায়নই বায়ুমন্ডলে মানবসৃষ্ট গ্রীণ হাউস গ্যাসের পরিমান কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষনায় দেখা যাচ্ছে যে, গাছের পাতা অনুজীবের উপস্থিতিতে মাটিতে পঁচে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতাও বাড়াতে সাহায্য করছে । বনায়ন, কার্বন স্টোরেজ, পানি ও বায়ু দূষণ কমানোয়, নিউট্রিয়েন্ট সাইক্লিং ও বন্যপ্রাণীর বাসস্থান প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া চিত্তবিনোদন ও ধর্মীয় উপসনালয়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে।

জাতিসংঘের এজেন্ডা অনুযায়ী, বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে টিকসই উন্নয়নের তালিকায় অন্তর্ভুক্তিতে বায়ুমন্ডলে নির্গত গ্রিন হাউজ গ্যাস কমিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব পরিবেশ দিবসে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত “টাইম ফর ন্যাচার” এর উদাহরণ দিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় কাঠ, খাদ্য, ঔষধ, জ্বালানি ও অন্যান্য বাইপ্রোডাক্ট বনায়ন হতে সংগৃহীত হচ্ছে । প্রধানমন্ত্রীর নের্তৃত্বে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত টিকসই রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সম্ভবনায় প্রধানমন্ত্রীর নের্তৃত্বে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বনায়ন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পরিবেশ সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে-আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, এনভাইরনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মতামত জানান