সোনারগাঁয়ে রিসোর্ট সিটি ও ইকোনমিক জোনের সব কার্যক্রম বাতিল-হাইকোর্ট
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নে ইউনিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিডেটের সোনারগাঁও রিসোর্ট সিটি ও সোনারগাঁও ইকোনমিক জোনের মাটি ভরাট কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। সোনারগাঁও রিসোর্ট সিটি ও ইকোনমিক জোন স্থাপনের প্রক্রিয়াকে আদালতের আদেশকে পাশ কাটানোর চেষ্টা বলেও অভিহিত করা হয়েছে রায়ে।
পিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়টি মৌজায় কৃষিজমি, জলাভূমি ও নদীর অংশবিশেষে মাটি ভরাট অবৈধ ঘোষণা করে আজ বুধবার বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্দেশনাসহ ওই রায় দেন। ছয় বছর আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় দেওয়া হলো।
কোম্পানির ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল পিরোজপুর ইউনিয়নে ছয়টি মৌজায়। ছয়টি মৌজা হচ্ছে পিরোজপুর, জৈনপুর, ছয়হিস্যা, চরভবনাথপুর, বাটিবান্ধা ও রতনপুর।
রায়ের পর আদালত বলেছেন, আদালতের আদেশ ভঙ্গ করায় রিসোর্ট সিটি ও ইকোনমিক জোনের সব কার্যক্রম বাতিল বটে। আর মেয়াদও (ইকোনমিক জোনের জন্য প্রাক্–যোগ্যতার লাইসেন্স) শেষ হয়ে গেছে।
ইউনিক প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূর আলী, যিনি রিটে ১১ ও ১২ নম্বর বিবাদী।
রায়ে বলা হয়, মেঘনা নদীর পার এবং ছয়টি মৌজার কৃষিজমি ও জলাভূমি ১১, ১২ প্রতিপক্ষসহ (বিবাদী) যেকোনো ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানের অবৈধ দখল সংবিধানের ১৮ (ক), পরিবেশ আইন এবং তুরাগ নদের মামলার পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিন অনুযায়ী অবৈধ।
ঘোষিত রায়ে আরও বলা হয়, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের নথিপত্র পর্যালোচনায় এটি কাচের মতো স্পষ্ট যে ১১ ও ১২ নম্বর প্রতিপক্ষ (বিবাদী) ছয়টি মৌজায় কৃষি ও জলাশয় আইন এবং আদালতের নির্দেশ অমান্য করে মাটি ভরাট করেছেন। যা আমাদের কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। মূল কর্ণধার নূর আলী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন যোদ্ধা।
সোনারগাঁও ইকোনমিক জোন স্থাপনের পুরো প্রক্রিয়া ছিল আদালতের আদেশকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়া। আদালতের বিভিন্ন তারিখের আদেশ এবং আপিল বিভাগের আদেশ ও অবমাননার আদেশ পর্যালোচনায় এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে আদালতের প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে পাশ কাটিয়ে ১১ ও ১২ নম্বর প্রতিপক্ষ যে অন্যায় কর্ম তথা জলাভূমি ও কৃষিভূমি দখলে যে মহোৎসবে লিপ্ত ছিলেন, তা স্পষ্ট। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১১ নম্বর বিবাদী ৫০ লাখ টাকা সরকারের কাছে জমা দিয়েছেন। ১২ নম্বর প্রতিপক্ষের (বিবাদী) প্রাথমিক লাইসেন্সের (ইকোনমিক জোন) মেয়াদ বর্ধিত না করে সরকারপক্ষ আদালতের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ওই ছয় মৌজার কৃষিজমি, জলাভূমি ও মেঘনা নদীর অংশবিশেষ ভরাট করে ইউনিক প্রপ্রার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড সোনারগাঁও রিসোর্ট সিটি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। এ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালে রিট করে বেলা। শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২ মার্চ হাইকোর্ট রুল দেন। ইউনিক প্রপার্টিজকে ওই এলাকায় মাটি ভরাট কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরপর সোনারগাঁও ইকোনমিক জোনের জন্য প্রাক্–যোগ্যতার অনুমোদন পেয়েছে জানিয়ে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড হাইকোর্টের আগের আদেশ সংশোধন চেয়ে আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিষেধাজ্ঞার আদেশ সংশোধন করে কার্যক্রম পরিচালনার আদেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে বেলা আপিল বিভাগে যায়, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের ইতিপূর্বে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার আদেশ বহাল রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রায় দেওয়া হয়।
আদালতে বেলার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মিনহাজুল হক চৌধুরী, আলী মুস্তফা খান ও সাঈদ আহমেদ কবীর। সোনারগাঁও ইকোনমিক জোন লিমিটেডের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুরাদ রেজা ও আহসানুল করিম। ইউনিক প্রপার্টিজ লিমিডেটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আবু তালেব।
আদালতের নির্দেশনা
রায়ে আদালত কয়েকটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সব মৌজায় ১১, ১২ নম্বর বিবাদীসহ যেকোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অবৈধ মাটি ও বালু ভরাটের বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে যৌথভাবে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
সেই তদন্তের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত সরকার হলে সরকারকে আর ব্যক্তি হলে ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিতে ভরাটকারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নূর আলীসহ যেকোনো ব্যক্তির মাধ্যমে ওই ছয় মৌজার কৃষি, জলাভূমি ও নিচু ভূমি ভরাটের বিষয়টিও তদন্ত এবং তার ভিত্তিতে ছয় মাসের মধ্যে পূর্বের অবস্থায় ভূমি ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া এখন থেকে ইকোনমিক জোন করতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করার পূর্বে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে অনাপত্তি এবং পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সনদ নিতে হবে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়। নূর আলী চাইলে নতুন করে আবেদন করতে পারেন বলে উল্লেখ করেছেন আদালত।
বেলার তথ্যমতে, স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই ছয় মৌজায় ২০০০ সালে যেখানে ২৫০ হেক্টর কৃষিজমিতে ১১টি সেচ প্রকল্প চালু ছিল, ২০১৮ সালে রবি মৌসুমে সেখানে মাত্র ৪৩ হেক্টর কৃষিজমিতে দুটি সেচ স্কিম সচল ছিল। ছয়টি মৌজা ও মেঘনা নদীর অংশবিশেষে ওই জায়গার পরিমাণ ১ হাজার ৮৬৮ বিঘা।
আপনার মতামত জানান