১৬ বছর পর ছেলেকে কাছে পেলেন বাবা-মা
জেলা প্রতিনিধি, কুমিল্লা:
আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দীর্ঘ ১৬ বছর কারাভোগের পর বাড়ি ফিরেছেন কুমিল্লার বিল্লাল হোসেন। গত বৃহস্পতিবার ( ২৩ জানুয়ারি) কুমিল্লার নিজ গ্রামে ফেরেন তিনি।
বিল্লাল হোসেন কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কালির বাজার ইউনিয়নের বুদুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য সুরুজ মিয়ার একমাত্র ছেলে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে বিল্লাল হোসেন সবার বড়। তার ছোট দুই বোন স্বামীর বাড়িতে।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর মুক্ত হয়ে ফিরে আসায় বিল্লালদের বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বইছে। আবেগাপ্লুত স্বজনরা আনন্দ অশ্রুতে মূর্ছা যাচ্ছেন। তাকে এক পলক দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষজন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বিল্লাল হোসেনের বাবা সুরুজ মিয়া বিডিআরের সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন। তার অবসরের পর একমাত্র ছেলে বিল্লালকেও যুক্ত করেন বিডিআরে। ২০০৭ সালের ৮ জুলাই সৈনিক পদে বিডিআরে চাকরি হয় বিল্লালের। ট্রেনিং শেষে পোস্টিং হয় ঠাকুরগাঁও ব্যাটালিয়নে। সেখান থেকে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরেন তিনি। কিছু দিন পর একটি খেলা উপলক্ষ্যে পিলখানায় পাঠানো হয় বিল্লালকে।
বিল্লাল হোসেন বলেন, পিলখানার ঘটনার দিন ডিউটি ছিল না। সেখানকার এমএমএস বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় থাকতাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনি। ঘটনাস্থল থেকে এমএমএস বিল্ডিংয়ের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। ফায়ারিংয়ের আওয়াজ শোনার পর সবাই এদিক-সেদিক ছুটোছুটি শুরু করেন। কী হয়েছে, কী হয়েছে জানতে উদগ্রীব সবাই হন্যে হয়ে ছুটছেন। প্রথম শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল টায়ার বিস্ফোরণের শব্দ। কিন্তু পরে বুঝা গেল এটা গুলির শব্দ। তখন আমরা রুমে চলে যাই।
তিনি বলেন, ২৬ তারিখ আমরা পিলখানা ত্যাগ করি। আমি ওইদিন কুমিল্লায় চলে আসি বন্ধুর বাসায়। পরবর্তীতে ঘোষণা এলো ১ তারিখের মধ্যে পিলখানার ৩ নম্বর গেটে যোগদান করার জন্য। আমরা সেখানে গেলে ৩ তারিখে আমরা আবাহনী মাঠে যাই এবং আমাদেরকে পিলখানায় প্রবেশ করায়। পরে আমাদেরকে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সিআইডিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকে নিরপরাধ হিসেবে আমার ব্যাটালিয়নে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বিল্লাল হোসেন বলেন, ২০১০ সালের আনুমানিক ১০ মার্চ আমি আমার নিজ ব্যাটালিয়ন ঠাকুরগাঁওয়ে যাই। পরবর্তীতে আমাকে সাক্ষী হওয়ার জন্য বলা হয়। আমি তখন বলেছি- আমি সাক্ষ্য দিতে পারব না, আমি তো ঘটনার সময় সেখানে ছিলাম না। স্বাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় আমাকে জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলাম। ২০১০ সালের ৫ মে আমাকে জেলে পাঠানো হয়। অবশেষে ১৬৮ জনের সাথে আমারও মুক্তি মেলে।
কারাগারের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৬ বছর অনেক কষ্টে কারাগারে দিন কেটেছে। ১৬ বছর আগে আমি যখন গ্রামে এসেছিলাম আমার ছোট বোন ক্লাস টু-তে পড়ত। এখন মুক্ত হয়ে দেখি ওর (ছোটবোনের) মেয়ে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। মাঝখানে কেটে গেল দীর্ঘ সময়। পরিবারের কথা মনে হলে অনেক কষ্ট হতো। বাবা-মা এবং বোনদের দেখতে না পারার কষ্ট ভীষণ পীড়া দিত। পরিবারের কথা মনে হলে সারাক্ষণ কান্না পেত।
সাবেক এই বিডিআর জওয়ান বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছি। ১৬ বছর আমরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করেছি। বাবা-মার একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান আমিই ছিলাম। আমাকে বিনা অপরাধে ১৬টি বছর জেলে থাকতে হয়েছে। আমার পরিবার খুবই কষ্টে দিন পার করেছে।
বিল্লাল বলেন, আমার জীবনের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব না। খুব অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমার এখন একটাই চাওয়া- আমি যেন আমার হারানো সম্মানটা ফিরে পাই। এর বাইরে আর কিছু চাওয়ার নেই। মিথ্যা কলঙ্ক থেকে আমি মুক্তি চাই। আমি যেন আমার আগের চাকরি জীবনে ফিরে যেতে চাই।
ছাত্র-জনতার ত্যাগকে স্মরণ করে বিল্লাল হোসেন বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে নতুন একটি বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। আমরা বিনা অপরাধে জেলে থাকার পর মুক্ত হয়েছি। এর সম্পূর্ণ অবদান ছাত্র-জনতার। তাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা।
বিল্লাল হোসেনের মা রেহেনা বেগম ( শানু) বলেন, সন্তানের যে কী ব্যথা সেটা একমাত্র মা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। মানুষ আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে যেত, কিন্তু আমি তো মা, মায়ের মন কী সন্তান ছাড়া বুঝ মানে? দীর্ঘ ১৬টি বছর পর একমাত্র ছেলেকে ছুঁয়ে দেখতে পেরেছি, এর আনন্দ প্রকাশ করা যাবে না।
বিল্লালের ছোট বোন তাছলিমা আক্তার বলেন, আমি যখন খুব ছোট তখন আমার ভাইকে জেলে পাঠানো হয়। বড় হয়ে এসব গল্প শুনতে পাই। মায়ের কান্না দেখে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না। আমাদের পরিবারের সবার কান্না দিয়ে একটা মহাসাগর হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করি যে ভাই আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে।
বিল্লালের বাবা সুরুজ মিয়া বলেন, ছেলেকে অনেক শখে বিডিআরের চাকরিতে পাঠিয়েছি। অনেক খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বছর দুয়েক চাকরি করার পর ছেলেটার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। আমার পরিবারটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। দীর্ঘ ১৬টি বছর ঢাকা কারাগারে যাওয়া-আসা করতে করতে আমার জীবন শেষ। একটা মাত্র ছেলে। কয়েকদিন পরপর তাকে দেখতে যেতাম। শারীরিক ক্ষতি তো হয়েছে, যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সেটা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা এই সরকারের মাধ্যমে সন্তানকে ফেরত পেয়েছি, সরকারকে ধন্যবাদ। সরকারের কাছে আকুল আবেদন সরকার যেন আমার ছেলের চাকরিটা ফেরত দেয়। ২ বছর চাকরি করে ১৬ বছর জেল খাটা ছেলেটার জীবনে অবশিষ্ট কিছু নেই।
আপনার মতামত জানান