১৫ আগস্টেই হয়েছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ

প্রকাশিত

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ঘাতকচক্র প্রচার করেছিল—‘মৃত্যুর পর শেখ মুজিবের জন্য কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি’, ‘কেউ ইন্না লিল্লাহিও পড়েনি’, ‘কেউ প্রতিবাদ করেনি’। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারফিউ উপেক্ষা করে ১৫ আগস্টই দেশের অন্তত ১০টি স্থানে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ হয়েছিল। সামরিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ওই বছরই আরো অন্তত ১১টি প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে দেশে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে গড়ে ওঠে সশস্ত্র প্রতিরোধ। প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন শতাধিক মুজিবভক্ত। সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, কারাদণ্ড ভোগ করেছেন বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা, তরুণ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সংঘটিত নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় সভা-সমাবেশ। ভয়, আতঙ্ক, গুজব আর অপপ্রচারের ফলে দেশে তৈরি হয় এক বিভীষিকাময় পরিবেশ। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে হত্যা করা হতে পারে—এটা ভাবতে পারেনি কেউ। ফলে হতবিহ্বল ও কিংবর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন নেতাকর্মীরা। দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো রাজনৈতিক কোনো নেতৃত্ব ছিল না। কিন্তু এর পরও থামিয়ে রাখা যায়নি প্রতিবাদ বিক্ষোভ। নজিরবিহীন কড়াকড়ি আর সামরিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বিভিন্ন জায়গায় দুঃসাহসী মুজিবপ্রেমীরা নেমে আসে রাস্তায়; বজ কণ্ঠে জানায় প্রতিবাদ, প্রকাশ করে ঘৃণা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৫ আগস্টই দেশের অন্তত ১০টি স্থানে বিক্ষোভ মিছিল, কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, প্রতিবাদী পোস্টার ও গায়েবানা জানাজার আয়োজন করা হয়। আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য নফল রোজা রাখা, নফল নামাজ আদায় তো ছিলই। ১৫ আগস্ট সকালেই বরগুনায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয় মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) সিরাজ উদ্্দীন আহমেদের নেতৃত্বে। তাঁর কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। রক্ষীবাহিনী সাত দিন বরগুনা শহর তাদের দখলে রাখে। কিশোরগঞ্জ শহরেও সকালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লোহিয়া মাঠে (বর্তমানে শহীদ আলী উসমান শিশু পার্ক) সকালেই প্রতিবাদসভা ও গায়েবানা জানাজা হয়।

বরিশাল শহরে সকালেই প্রতিবাদ মিছিল করেন ছাত্রলীগকর্মীরা। কিন্তু ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রলীগেরই আরেকটি অংশ তাদের ওপর হামলা করেছিল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই দিন বিকেলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ওই বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। সেনাবাহিনী ক্যাম্পাসে এসে বিক্ষোভকারীদের কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু এক পর্যায়ে ছাত্রবিক্ষোভের আশঙ্কায় প্রশাসন তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

বঙ্গবন্ধুর নিজের জেলা গোপালগঞ্জে প্রতিবাদ সংগঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন গোপালগঞ্জ জেলার সভাপতি কমরেড শওকত চৌধুরীর নেতৃত্বে; যার কারণে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রতিবাদ মিছিল বের হয়েছিল ‘নেতাজি’ শেখ সেকান্দারের নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ এই নেতা অসুস্থ হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতারা সকালে প্রতিবাদ সভা ও গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেই বসে থাকেননি, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য একটি আঞ্চলিক কমিটিও গঠন করেছিলেন। কমিটির একটি সভা মোহনগঞ্জের মল্লিকপুরে ১৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানা যুবলীগের নেতাকর্মীরা ওই দিন রাতে ঝটিকা মিছিল, থানা সার্কেল অফিসসহ সরকারি ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন আর হাতে লেখা পোস্টার সাঁটিয়ে প্রতিবাদ জানান। ওই দিনই মালয়েশিয়ার ফুটবল মাঠে প্রতীকী প্রতিবাদ করেছেন বাংলাদেশ ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা। ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামালসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর শুনে খেলতে অস্বীকৃতি জানান খেলোয়াড়রা। পরে খেলা অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে।

সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড়ের মাধ্যমে দমন করা হয় প্রতিবাদের চেষ্টা। রাজধানীতে ২৩ আগস্ট থেকে ধরপাকড় শুরু হলেও ঢাকার বাইরে ধরপাকড় শুরু হয়ে যায় ১৭ আগস্ট থেকেই। এই দমন অভিযানে কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে জেলা, মহকুমা, থানা ছাড়িয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদেরও আটক হয়। আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের নির্বিচার গ্রেপ্তারের ফলে ভরে ওঠে সারা দেশের জেলখানা। ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসার পর আটক তালিকায় যুক্ত হয় জাসদ নেতাকর্মীদের নাম। সারা দেশের জেলায় জেলায় স্থাপন করা হয় সামরিক আদালত। সামরিক আদালতে শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের বিচার।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে দুটি থানার আটক অভিযানের তথ্য। ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানায় ১১ জন ও সিলেটের বিয়ানীবাজার থানায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে আওয়ামী লীগের প্রায় সাড়ে চার লাখ নেতাকর্মী কারাগারে বিনা বিচারে আটক বলে ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদে জানান আওয়ামী লীগের এমপি সুধাংশু শেখর হালদার। আরেক তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে শুধু ময়মনসিংহ জেলেই রাজবন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০।

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে আরো ১১টির মতো। এই সময়ের প্রতিবাদ ছিল নানামাত্রিক। প্রতিবাদের মধ্যে ছিল বিক্ষোভ মিছিল, শোক মিছিল, গায়েবানা জানাজা, লিফলেট প্রচার, বুকলেট প্রকাশ, দেয়াল লিখন, পোস্টার লাগানো, স্মরণসভার আয়োজন। চট্টগ্রাম, পাবনায়ও অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ মিছিল। গায়েবানা জানাজা হয় যশোরে। রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সংসদীয় দলের সভায় সরাসরি প্রতিবাদ করেন এমপিরা। প্রতিবাদী পোস্টার লাগানো হয় সিলেট ও যশোরে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন লিফলেট প্রচার করে রাজধানীতে।

১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর রমজান ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে দীর্ঘ সময় ছুটি থাকার পর ১৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বাড়ি পর্যন্ত শোকযাত্রা অনুষ্ঠিত ৪ নভেম্বর। ওই দিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদসভা। জেলহত্যার প্রতিবাদে রাজধানীতে হরতাল পালন করা হয় ৫ নভেম্বর।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। জনমত গড়ে তোলার জন্য সিপিবি বেশ কয়েকটি লিফলেট, বুকলেট, চার পাতার পত্রিকা ছাপিয়ে প্রচার করতে থাকে। ন্যাপ পকেট সাইজের একটি বুকলেট ছাপিয়ে প্রচার করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেন মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা-যুবনেতা মৌলভি সৈয়দ। আগস্ট মাসেই কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সশস্ত্র প্রতিরোধ। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কাদের সিদ্দিকীর ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’তে যোগ দেয় হাজার হাজার ছাত্র, তরুণ, মুক্তিযোদ্ধা। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্তে ভারতের চান্দুভূই নামক স্থানে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে শুরু করে নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ-শেরপুর-জামালপুর-কুড়িগ্রামের রৌমারী পর্যন্ত সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ।

কাদের সিদ্দিকীর ভাষ্য মতে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত চলমান ওই প্রতিরোধ-সংগ্রামে শাহাদাতবরণ করেন ১০৪ জন বীর যোদ্ধা। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয় মুক্তিবাহিনী ’৭৫ গবেষণাকেন্দের চেয়ারম্যান যুগল হাশমী জানান, ৮৩ জন শহীদ প্রতিরোধ যোদ্ধার নাম তাদের কাছে রয়েছে। আরো রয়েছে প্রতিরোধ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধসহ তিন শতাধিক আহতের তালিকা। কয়েক হাজারের বিরুদ্ধে হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। তাঁরা অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হন। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারে বন্দি থাকতে হয় আরো অন্তত ৮১ জনকে।

আপনার মতামত জানান