সিগন্যাল ব্যবস্থা পুরোনো, রেলে ঘটছে দুর্ঘটনা
নিরাপদ ভ্রমণে বাহন হিসেবে সবার পছন্দ ট্রেন। যদিও বাংলাদেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা যুগের সঙ্গে এখনো তাল মেলাতে পারেনি। পুরোনো সিগন্যাল পদ্ধতিতেই চলছে রেলওয়ের বেশিরভাগ স্টেশন। সারাদেশের ৪৮৩টি স্টেশনের মধ্যে অর্ধেকই চলছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। ১৩০টি স্টেশনে নেই কোনো সিগন্যাল ব্যবস্থা। সিগন্যাল অমান্য কিংবা সিগন্যালের ভুলের কারণে হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্বের ঘটনার পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে রেলওয়ের অবকাঠামোরও।
২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর ঝিনাইদহের সাফদালপুরে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ট্রেন দুটির একটি ছিল মালবাহী, অন্যটি জ্বালানি তেলবাহী। এই দুর্ঘটনায় ট্রেন দুটির ইঞ্জিনসহ রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নষ্ট হয় এক লাখ ৫০ হাজার লিটার জ্বালানি তেল। রেলের তদন্তে বেরিয়ে আসে দুর্ঘটনার কারণ। সিগন্যাল অমান্য করায় এ দুর্ঘটনা ঘটে, আর এর দায় দেওয়া হয় রেলওয়ের যান্ত্রিক বিভাগকে।
তার আগের বছর ২০১৯ সালের নভেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মারা যান ১৭ যাত্রী। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চালকের সিগন্যাল অমান্য করার বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে।
সম্প্রতি ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় উপস্থাপন করে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক ঘটা দুর্ঘটনার জন্য সিগন্যাল ব্যবস্থার ভিন্নতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় সেই প্রতিবেদনে।
বিভিন্ন স্টেশনের সিগন্যালে সিবিআই কালার লাইট, নন-ইন্টারলকড কালার লাইট, সিমাফোর আপার কোয়াড্রেন্ট, সিমাফোর লোয়ার কোয়াড্রেন্ট, কেরোসিন বাতি, সোলার প্যানেল, বৈদ্যুতিক বাতিসহ নানা ধরনের সিগন্যালিং সিস্টেম ও সিগন্যাল বাতির কারণে ট্রেনচালকরা (লোকোমাস্টার) বিভ্রান্ত হচ্ছেন বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়।
জানা গেছে, দেশে ৪৮৩টি রেলস্টেশন আছে। যার মধ্যে পাঁচ ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা আছে ৩৫৩টিতে। ২২টি স্টেশনে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সর্বাধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং। এছাড়া কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলকিং সিস্টেম (সিবিআই) ব্যবস্থা আছে ১১২টি স্টেশনে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের (সদর) বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী (ডিএসটিই) রুবাইয়াৎ শরীফ জাগো নিউজকে বলেন, রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং ও সিবিআই—এ দুটি সিগন্যাল ব্যবস্থাই আধুনিক বলা যায়। ১১২টি স্টেশনকে কম্পিউটারাইজড করা হয়েছে। নতুন যে স্টেশনগুলা করা হবে সেগুলোতেও সিবিআই সিগন্যাল ব্যবহার করা হবে। এছাড়া যেসব স্টেশন পুরোনো সিগন্যালে চলছে সেগুলোও আধুনিক করা হবে।
জানা গেছে, ২১৯টি স্টেশন চলছে পুরোনো সিগন্যাল ব্যবস্থায়। যার মধ্যে ১২২টি স্টেশনে লাল-সবুজ বাতি বা ইন্টারলকড কালার লাইট সিগন্যালিং ব্যবহার করা হয়। ২৫টি স্টেশনে সম্পূর্ণ ম্যানুয়ালি রেললাইন নির্ধারণ করা হয়। এসব স্টেশনে ট্রেন প্রবেশের আগ মুহূর্তে স্টেশনমাস্টার ঠিক করেন, কোন লাইন দিয়ে ট্রেনটি যাবে। সেভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা ট্রেন যাওয়ার লাইনটি ঠিক করে দেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় নন-ইন্টারলকড মেকানিক্যাল সিগন্যালিং সিস্টেম। আর ১৩০টি স্টেশনে কোনো রকম সিগন্যালিং সুবিধা নেই। যদিও রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের স্টেশনে ট্রেন চলাচল না থাকায় সেখানে সিগন্যালের প্রয়োজন পড়ছে না।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলওয়ের সব রুটে অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন হয়েছে। চলতি বছরের জুনের আগেও দুই হাজার ৬২৬ কিলোমিটার এই অপটিক্যাল ফাইবার ছিল। সম্প্রতি আরও ৫৮৩ কিলোমিটার লাইনে গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট বসানো হয়েছে। কপার ক্যাবলের পরিবর্তে অপটিক্যাল ফাইবার বসানোয় রেলে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের আধুনিকায়ন শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, অল্প কিছু স্টেশনে ম্যানুয়াল সিগন্যাল আছে। সেখানে হয়তো ট্রেন কম যাচ্ছে। ট্রেনে আধুনিকায়ন জরুরি। এজন্য সিগন্যালগুলোও কম্পিউটার-বেইজড করতে হবে।
তিনি বলেন, কোনো ট্রেন সিগন্যাল ভায়োলেট (অমান্য) করলে তাকে যেন তাৎক্ষণিক বন্ধ করা যায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্টেশনগুলোতে ডিজিটাল সিগন্যাল সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে।
আপনার মতামত জানান