সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রশাসন ক্যাডার ও আমাদের গালিবর্ষণ!

প্রকাশিত

প্রতিনিয়ত ফেসবুক খুললেই দেখি- ছোট খাটো বিভিন্ন ইস্যুতে সুযোগ পেলেই প্রশাসন ক্যাডার তথা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের গালাগালিতে ভরে দিচ্ছি আমি-আপনিসহ কিছু আবাল-সুশীল শ্রেণির লোকজন!!! কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরাও এ ধরনের গালাগালির সহজ শিকার হচ্ছেন!!! কিন্তু কেন- কি অন্যায় করেছে তারা? আসুন দেখা যাক-

১। প্রথমেই সাম্প্রতিক করোনা যুদ্ধে জেলা প্রশাসন-উপজেলা প্রশাসন তথা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ গুলো পড়ার অনুরোধ রইল।

২। করোনা ইস্যুতে সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এ ছুটিতে আমি-আপনি কি করছি? ঘরে বসে কোয়ারেন্টাইনে থেকে বিছানায় শুয়ে বা নরম সোফায় বসে ফেসবুকে তাদের বিরুদ্ধে চুলকানি দিচ্ছি ! আর তারা কি করছেন- ৬৪ জন জেলা প্রশাসক, ৩০০ এর অধিক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ৪৯২ জন ইউএনও, ৪৯২ জন এসি(ল্যান্ড) আর মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ১২০০ এর অধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিনিয়ত ২৪/৭ আপনাকে ভালো রাখার জন্য আবারও বলছি শুধু আপনাকে করোনামুক্ত রাখার জন্য- যারা কোয়ারেন্টাইন ভঙ্গ করে রাস্তায় বের হচ্ছেন তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে বাধ্য করার জন্য শুক্রবার কি ? শনিবার কি ? ছুটির দিন- ২৪/৭ অমানুষিক পরিশ্রম করে সারা দেশ ব্যাপী ছুটাছুটি করছেন। অবিরাম দৌঁড়াচ্ছেন !! এ সময় কাউকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাধ্য করছেন, কারো ক্ষেত্রে বা কঠোর হচ্ছেন, কারো ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে কিছু নিয়মের ব্যতয় ঘটাচ্ছেন। যা করছেন- আপনার জন্যই, আপনার ভালোর জন্যই করছেন। কিন্তু আপনি তখন আবার মশারীর ভেতর থেকে গালাগালি করে তার পারিবারিক-সাংসারিক চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন। যে কর্মকর্তা দিন-রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে, পরিবার পরিজন থেকে দূরে থেকে শুধু আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন- তার একটুখানি বুঝার ভুলের কারণে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করলেন, তাকে ধর্ষণ করার হুমকি দিলেন । ফলাফল- রাস্তাঘাটে আবারও মানুষের সমাগম। জানিনা এর ভয়াবহতা কি হতে পারে ?

৩। করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে আমি-আপনি হোম কোয়ারেন্টাইনে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকের প্রোফাইল থেকে শুরু করে সব জায়গায়- “Stay Home- Be Safe” লিখে প্রচারণা চালাচ্ছি। কিন্তু আমার-আপনার গালি খাওয়া সেসব দুর্ভাগা প্রশাসনের লোকজনের কি সুযোগ আছে এ দুর্যোগে বাসায় থাকার ? জ্বি, আমাকে, আপনাকে নিরাপদে বাসায় রাখার জন্যই তারা অনিরাপদভাবে নিরলস ২৪/৭ বাইরেই কাজ করছেন।

৪। আমি-আপনি যখন তাদের গালাগালি করে তারা কোথায়-কখন কি ভুল করেছেন তা বাটিচালা দিয়ে খুঁজে বের করে ফেসবুকে চুলকানি দিচ্ছি তখন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার এসি(ল্যান্ড) ডাক্তার কাজী নাজিব হাসান (৩৫ তম ব্যাচ) সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে নিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে ঝিকরগাছার গদখালী বাজার মোড় থেকে একটু সামনে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়ালে এক মোটরসাইকেল আরোহী হঠাৎ করে ওর গায়ের উপর দিয়ে মোটরসাইকেল তুলে দেয়। এতে ঐ এসি(ল্যান্ড) মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং তার ডান পায়ের ফিবুলা ও ডান ক্ল্যাভিকল ভেঙে গেছে, মাথায় এবং পিঠেও কিছুটা আঘাত পেয়েছে। আসুন লুডু খেলতে খেলতে তালিয়া বাজাই !

৫। সারাদেশে এখনো পর্যন্ত ৫ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও মৃতদেহের কাছে ভিড়ছেননা বা ভিড়তে দেয়া হচ্ছেনা। তাহলে কে মৃতদেহ দাফন করবে? আমার-আপনার গালি খাওয়া সে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাই সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থায় শুধু মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে করোনার ঝুঁকি নিয়ে সেসব মৃতদেহ দাফন করছেন।

৬। আমি-আপনি যখন বাজারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুদ করছি, অসাধু ব্যবসায়ীরা এ সুযোগে জিনিসপত্রের দাম দিল বাড়িয়ে দিলে আমার-আপনার গালি খাওয়া সে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তখন দিন-রাত ২৪/৭ অসাধু ব্যবসায়ীদের আড়তে আড়তে ছুটাছুটি করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করছেন।

৭। সারাদেশ যখন লকডাউন- আমি-আপনি তখন মজুদ করা খাবার খেয়ে ফেসবুকে চুলকানি দিচ্ছি, অসহায় দিন-মজুররা তখন কাজের অভাবে না খেয়ে মরছে- আমার-আপনার গালি খাওয়া সে জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসি(ল্যান্ড), নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তখন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। ২৪/৭ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন !

৮। প্রতি বছর ঈদ আসে-পূজা আসে। আমি-আপনি সরকারি ছুটির সাথে সাপ্তাহিক এবং নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে ৮-১০ দিনের জন্য বাড়ি যাই, ওরা তখন আমার-আপনার বাড়ী যাওয়া নির্বিঘ্ন করতে ২৪/৭ অমানুষিক পরিশ্রম করেন। কখনো কি ভেবেছেন? আপনি যখন পরিবারের সঙ্গে নিরাপদে ঈদ-পূজা উদযাপন করেন, আপনার গালি খাওয়া প্রশাসনের বন্ধুরা তখন কোথায় ঈদ-পূজা উদযাপন করে ? আপনার ঈদ-পূজা উদযাপন নিরাপদ করতে তারা তাদের ঈদ-পূজা উদযাপন বিসর্জন দেন !

৯। গত বছর ডেঙ্গুর মৌসুমে ঈদ এবং ডেঙ্গু একসাথে হল। আপনি ঈদ উদযাপন করছেন পরিবার-পরিজনের সাথে আর প্রশাসনের ইউএনও-এসি(ল্যান্ড) সহ সকল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বাস স্টেশন-রেল স্টেশনে ২৪/৭ পাহারা দিয়েছে- যেন এ ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে না যায় ! তাদের ঈদ কেটেছে রাস্তা-ঘাটে !

১০। সপ্তাহ ঘুরে শুক্রবার আসে- শনিবার আসে, আপনি প্রিয়জনের কাছে ছুটে যান। উপজেলা পাহারা দেয় কে জানেন ? হ্যাঁ, আপনার গালি খাওয়া ইউএনও-এসি(ল্যান্ড)রাই পাহারাদার হন- যেন কোথাও দুর্যোগ নেমে আসলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

১১। অফিস টাইম নাকি ৯টা-৫টা। আমি-আপনি ৫টা বাজতেই ব্যাগটা গুছিয়ে বাসার দিকে হাঁটা ধরি। জেলা প্রশাসন বা উপজেলা প্রশাসনের কাউকে ৭/৮ টার পূর্বে খুব কমই দেখা যায় অফিস থেকে বের হচ্ছেন। তার উপর রয়েছে অফিসিয়াল নাম্বারে ২৪/৭ সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয়/অপ্রয়োজনীয় ফোনের যন্ত্রণা।

১২। দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দুর্যোগ নেমে আসে! সরকারি ঘোষণা আসে- অমুকের ছুটি বাতিল- তমুকের ছুটি বাতিল। কখনো দেখেছেন কি- প্রশাসনের কারো ছুটি বাতিল হয়েছে? দেখবেন কিভাবে- ওদের তো ছুটিই নেই, বাতিল হবে কিভাবে? যেকোন দুর্যোগে সবার আগে কাদের ছুটে যেতে হয় জানেন ? আপনার-আমার গালি খাওয়া প্রশাসনের ডিসি-ইউএনও’দেরকেই ছুটে যেতে হয়।

১৩। একটা কমন গালি সবসময় করেন- কথায় কথায় জনগণের চাকর, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নেন বলে গালি দেন। এ বেতন কি জনগণ করুণা করে দেয়- নাকি এটা তাদের কাজের পারিশ্রমিক ? জনগণ কারা আর ওরা কারা? ওরা কি জনগণ নয়? ওরা কি ভিনদেশ থেকে আসছে? ওরা কি সরকারকে ট্যাক্স দেয় না ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিসহ দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যান, গিয়ে দেখেন কি অবস্থা! যে পেশাকে আমি-আপনি তুচ্ছ করে জনগণের চাকর বলে গালি দিই- সে পেশায় যাওয়ার জন্য দেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী কিরকম সংগ্রাম করে নিজেদেরকে তৈরি করছে। এ চাকর হওয়ার জন্য প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী চেষ্টা করে- যারা তাদের নিজ যোগ্যতায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাদেরকে সরকার মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করে এবং সবচেয়ে মেধাবীরাই নিয়োগ পায়। তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে জনগণের সেবা করে এবং তার বিনিময়ে সরকার তাদের বেতন দেয়, তারা পারিশ্রমিক পায়। কিন্তু যারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনা বা সেখানে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা- তারা এ সহজ বিষয়টাকে সহজভাবে না নিয়ে কথায় কথায় জনগণের চাকর বলে গালি দেয়। জনগণের সেবা করা আর জনগণের চাকর কি এক জিনিস ? যে পোশাকের নিচের ছবিগুলো আর একবার ভালো করে দেখুন! তারপর আবার হোম কোয়ারেন্টাইনে বসে ইচ্ছেমত গালাগালি করুন। কারণ তারা দেশের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজ যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়ে ১ম চয়েজ হিসেবে নিজের ইচ্ছায় বিসিএস(প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করে জনগণের সেবায় ২৪/৭ নিয়োজিত রয়েছে আপনাদের গালি খাওয়ার জন্যই। তাই আসুন সবাই মিলে একসাথে তাদের ইচ্ছেমত গালি দিই। পরিশেষে বিসিএস(প্রশাসন) ক্যাডারের প্রিয় ভাইদের প্রতি-

“ওরা যতই প্রচার করুক, হিংসার বাণী
আমাদের কাজ কি- আমরা তা জানি”
“জনসেবায় প্রশাসন- এ হোক আমাদের ব্রত”

লেখক : শামীম আজগর
সিনিয়র সহকারী সচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

আপনার মতামত জানান