“সাংবাদিক নির্যাতনকারীদের সঙ্গে বেয়াদব এসপির কীসের পীড়িতি?”

প্রকাশিত


সাঈদুর রহমান রিমন:
ভোলার পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ শরীফুল হককে সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষ ভেবে কেউ ভুল করবেন না। ফ্যাসিস্ট সরকারের গুড লিস্টেড পুলিশ অফিসার হিসেবে তার ক্রমিক নাম্বার ৩১। জুলাই-আগস্টের বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের কোথাও তাকে পদায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না-আবার ওই সময়ের কর্মস্থল সিরাজগঞ্জ ইনসার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ড্যান্ট (পুলিশ সুপার) হিসেবে বহাল রাখাও ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় ৩ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ তড়িঘড়ি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শরীফুল হককে দ্বীপ জেলা ভোলার পুলিশ সুপার পদে নিয়োগ দিয়ে দুই কুলই রক্ষা করতে সক্ষম হয়।

ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার গ্রামীণ মহল্লার বাসিন্দা বহুল বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফুল হক বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের ২৫তম ব্যাচের সদস্য। পুলিশে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই দুর্ব্যবহার, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, শৃঙ্খলা ভঙ্গের অসংখ্য ঘটনার নায়ক শরীফুল হককে বারবার সতর্ক করেও ভালো বানানো যায়নি। যেখানেই তাকে পদায়ন করা হতো সেখানেই গ্রুপিং, লবিং, সংগঠন, সমিতি বানিয়ে হযবরল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতেন তিনি। টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে থাকাবস্থায় শরীফুল হক বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতি গঠন করে নানারকম অনুষ্ঠানের নামে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ উঠে। ওই সমিতির তিনি স্বঘোষিত সাধারণ সম্পাদক হয়েই জেলা জুড়ে তদবিরবাজী, কথিত অনুদান সংগ্রহের নামে লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করাসহ নিজস্ব দাপুটে বলয় গড়ে তোলেন।

বিষয়টি মোটেও ভালোভাবে নেয়নি পুলিশ সদর দপ্তর। ২০২০ সালের ১৮ জুন তাকে হটিয়ে দেওয়া হয় সিরাজগঞ্জে। সেখানে জনসম্পৃক্ততাহীন ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ড্যান্ট পদে পদায়ন করে অনেকটা নির্বাসনেই পাঠানো হয়। অনেক চেষ্টা-তদবির, কাঠখড় পুড়িয়েও শরীফুল হক ওই ট্রেনিং সেন্টারের খাঁচামুক্ত হতে পারছিলেন না। তবে গেল জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতিতে সিরাজগঞ্জ রীতিমতো অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে। উত্তাল ছাত্র-জনতা তখন ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের দালাল পুলিশ অফিসার ঘোষণা দিয়ে শরীফুল হককে শায়েস্তা করতে উদ্যত হয়। অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ৩ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেয় তাকে, ১০ সেপ্টেম্বর পদায়ন করা হয় ভোলার পুলিশ সুপার হিসেবে।

বিচ্ছিন্ন দ্বীপজেলা ভোলার মানুষজন শরীফুল হককে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করে নিলেও নিজের স্বভাব চরিত্র একটুও বদলাননি তিনি। সেখানে যোগদানের পর থেকেই পুলিশের মধ্যে অতিগোপনে ıভক্ত গ্রুপ, আঞ্চলিক গ্রুপ, লীগ গ্রুপIJ ইত্যাদি নানা গ্রুপে বিভক্তি সৃষ্টির ভয়ংকর পাঁয়তারায় মেতে ওঠেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সাংবাদিক নির্যাতনে ঘুমান এসপি, পুলিশের কিছুতে তুলকালাম
—————–
তার ভক্ত ও লীগ গ্রুপের পুলিশ সদস্যদের সুরক্ষা দিতে এসপি সদা ব্যস্ত থাকেন। গত ৪ মার্চ রাতে এসআই জাফর, এএসআই কামরুল ইসলামসহ তিন পুলিশ সদস্য সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় ভোলার বোরহানউদ্দিনের পল্লীতে অভিযান চালিয়ে আকবার নামে এক ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে আটক করে। এসময় আকবারের সমর্থকরা পুলিশের উপর চড়াও হয়ে তাকে ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনায় রাতেই তুলকালাম বাধিয়ে দেন এসপি। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, দুই জন সহকারী পুলিশ সুপার, ছয় জন ইন্সপেক্টরসহ অর্ধশতাধিক পুলিশ ও ডিবি সদস্যকে পাঠিয়ে অভিযানের নামে অমানবিক বর্বরতা চালান। পুলিশের তাণ্ডবলীলায় কয়েক গ্রামের আতঙ্কিত পুরুষরা এলাকা ছেড়ে নৌকাযোগে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তখন বাড়িঘরে হানা দিয়ে ঘুমন্ত শিশু, যুবক, বৃদ্ধ ১২ জনকে আটক করে অমানবিক নিষ্ঠুরতা চালানো হয়। তাদেরকে থানায় নিয়েও টানা ৫/৬ ঘণ্টা নির্যাতন চালিয়ে তবেই আদালতে পাঠানোর ঘটনা ঘটে।

অথচ একইদিন (৪ মার্চ) প্রকাশ্য দিবালোকে জেলা শহরে দৈনিক ভোলা টাইমস পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রাজিব ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল ভোলা প্রকাশের সম্পাদক বিজয় বাইন দুর্বৃত্তদের নির্মম হামলায় গুরুতর আহত হলেও পুলিশ সুপার সেদিকে ফিরেও তাকাননি। এ ব্যাপারে ভোলা সদর থানায় চার অভিযুক্তের নাম উল্লেখ করে মামলা রুজু করা হলেও তাদের গ্রেফতারে বাধা দিচ্ছেন খোদ এসপি। শুধু তাই নয়, মামলায় এজাহারভুক্ত আসামিরা গত রাতেও এসপির সঙ্গে চা চক্রে মিলিত হওয়ার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব নিয়ে ক্ষোভ-প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভোলা, সেখানকার সাংবাদিকরা আজ মানববন্ধনও করেছেন। এ ব্যাপারে ঢাকার সাংবাদিক নেতারা যোগাযোগ করলে এসপি শরীফুল হক চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং মামলা হলেই আসামি গ্রেফতারের বিধান নেই বলে মন্তব্য করেন। ভোলায় এখন প্রশ্ন উঠেছে, “সাংবাদিক-সম্পাদকদের উপর হামলাকারীদের সঙ্গে বেয়াদব এসপি শরীফুলরে কীসের পীড়িতি?”

আপনার মতামত জানান