শিশুদের রমজান পালনে অভ্যস্ত করতে বাবা মার করণীয়

প্রকাশিত

আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে অন্যকে অনুকরণ-অনুসরণ করার একটা সহজাত প্রবৃত্তি দান করেছেন। এটা ছোটদের মধ্যে আরো বেশি ক্রিয়াশীল। তারা বড়দের অনুসরণ করে, অনুকরণ করে। অন্যকে দেখে দেখে, শুনে শুনে শেখে। আশপাশের মানুষজন থেকে শিখতে শিখতে বড় হয় শিশুরা। শৈশবে কোনো কাজে বা আমলে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে বড় হয়ে তা করা সহজ হয়।

শিশুরা মা-বাবার অনুকরণ করে : শিশুরা আশপাশের লোকজন ও পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত। এ ক্ষেত্রে শিশুর মা-বাবা এবং তার আশপাশে যারা থাকে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবার ওপর সন্তানের অধিকার হলো তাদের সুন্দরভাবে গড়ে তোলা, উত্তমরূপে পরিচর্যা করা, সুশিক্ষা প্রদান করা। তাই প্রত্যেক মা-বাবার দায়িত্ব তার সন্তানকে ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া, ইবাদতের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা, তাদের অন্তরে দ্বিনি শিক্ষার বীজ বপন করা।

হাদিসে ঘরে নফল নামাজ আদায় ও কোরআন তিলাওয়াত করতে বলা হয়েছে, যাতে শিশুরা তা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়। শিশুর মনে নামাজের প্রতি ভালোবাসা এবং তা পালনে সচেষ্ট হওয়ার জন্য রাসুল (সা.) সাত বছর বয়স হলেই শিশুদের নামাজ পড়ার আদেশ দিতে বলেছেন। অবশ্য রোজা অন্যান্য ইবাদত থেকে ভিন্ন। এতে প্রয়োজন শারীরিক সক্ষমতা।

সাহাবাযুগে শিশুর রোজায় অভ্যস্ত হওয়ার দৃশ্য : সাহাবায়ে কেরাম শিশুর পরিচর্যার ব্যাপারে সজাগ থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই তাদের নামাজ-রোজার প্রতি অভ্যস্ত করাতেন। ইবাদতের প্রতি তাদের অগ্রহী করে তুলতেন। এ ক্ষেত্রে রুবাইয়ি বিনতে মুআওয়িজ (রা.) বলেন, ‘আশুরার দিন সকালে রাসুল (সা.) আনসারদের সব পল্লীতে এই নির্দেশ দিলেন, যে ব্যক্তি রোজা পালন করেনি, সে যেন দিনের বাকি অংশ না খেয়ে থাকে; আর যারা রোজা রেখেছে, সে যেন রোজা পূর্ণ করে। পরবর্তী সময়ে আমরা ওই দিন রোজা রাখতাম এবং আমাদের সন্তানদের রোজা রাখাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ওই খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৬০)

হাদিসের বর্ণনায় শিশুদের রোজা : ইমাম বুখারি (রহ.) তাঁর সহিহ বুখারিতে ‘বাবু সাওমিস সিবয়ান’ তথা ছোটদের রোজার রাখার বিধান নামে একটি অধ্যায় স্থাপন করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, রমজান মাসে এক নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে ওমর (রা.) বলেন, ‘আফসোস তোমার জন্য! আমাদের ছোটরা রোজা রাখে আর তুমি রোজা রাখো না!’

একবার একজন নারী রাসুল (সা.)-এর কাছে একটি শিশুকে নিয়ে আসে। ওই নারী জিজ্ঞেস করল, এই শিশুর জন্যও কি হজের বিধান রয়েছে? তখন রাসুল (সা.) বলেন, হ্যাঁ, আর তোমার জন্য আছে সওয়াব। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২৮২)

উপর্যুক্ত তিনটি হাদিস থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। শিশুদের নামাজ-রোজাসহ অন্যান্য ইবাদতে অভ্যস্ত করানো, শিশুদের রোজা রাখার বৈধতা এবং শিশুরা ভালো কাজ করলে বা নামাজ, রোজা, হজ আদায় করলে মা-বাবাও তার সওয়াব পাবে।

যেভাবে ছোটদের রোজার প্রতি অভ্যস্ত করাব : শিশুমনে ইসলামী বিধি-বিধানের প্রতি ভালোবাসা তৈরি এবং তাদের তা পালনে অভ্যস্ত করাতে রমজান মাস ও রমজানের রোজা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তারাবি, সাহরি, ইফতার, কোরআন তিলাওয়াতের যে সামগ্রিক পরিবেশ তৈরি হয়, তা শিশুমনে ইবাদতের আগ্রহ তৈরি করে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে কারো ওপর রোজা ফরজ নয়। কেননা রাসুল (সা.) বলেন, তিন প্রকারের ব্যক্তি থেকে (হিসাব-নিকাশের) কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে—পাগল, ঘুমন্ত ব্যক্তি ও নাবালগ শিশু। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪০১)

তবে শিশুদের রোজায় অভ্যস্ত করাতে রোজা রাখানো মুস্তাহাব বলে মত দিয়েছেন বিজ্ঞ আলেমরা।

শিশুরা যেভাবে রোজা রাখতে অভ্যস্ত হয় : নিম্নে বর্ণিত কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করলে শিশুরা রমজানের রোজা রাখায় অভ্যস্ত হবে –

মানসিক প্রস্তুতি : ছোটদের ওপর শরিয়তের বিধি-বধান মেনে চলা আবশ্যক নয়। তবে তাদের শরিয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার প্রতি অভ্যস্ত করাতে হবে। তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। এই মানসিক প্রস্তুতি তাদের পরবর্তী সময়ে শরিয়তের যেকোনো বিধান পালন করাটা সহজ করে দেবে। সেই লক্ষ্যে তাদের হৃদয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি ভালোবাসা এবং তা পালনে আগ্রহী করে তোলা।

কৌশল অবলম্বন করা : ছোটদের রোজার প্রতি অভ্যস্ত করতে উপযোগী কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ধীরে ধীরে রোজা পালনের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। প্রথম দিকে অর্ধদিন এবং ধীরে ধীরে পূর্ণদিন রোজা রাখার প্রতি অভ্যস্ত করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছোটরা রোজা রাখলে তাদের প্রশংসা করা। পরিবারে একাধিক নাবালগ বাচ্চা থাকলে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে হবে। ক্ষুধার কথা বললে, ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া বা খেলায় ব্যস্ত রাখবে—যেভাবে সাহাবারা করতেন। তবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেবে, বেশি অসুবিধা মনে করলে ওই দিনের রোজা ভেঙে পরের দিন আবার চেষ্টা করবে।

রোজার মর্যাদা বর্ণনা করা : যেকোনো বিষয়ের মর্যাদা জানা থাকলে তার প্রতি গুরুত্ব বাড়ে। ছোটদের রোজা ও রমজানের মর্যাদা বর্ণনা করা, যাতে তারা রোজা পালনে উৎসাহিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতি কখনোও কঠোরতা প্রদর্শন করা যাবে না। রোজা না রাখলে বকাঝকা করা যাবে না।

পুরস্কার দেওয়া : ছোট বাচ্চারা রোজা রাখলে তাদের জন্য বড়দের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। তাদের পছন্দনীয় জিনিস পুরস্কার দেবে। এটি ছোটদের রোজা রাখতে উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত করবে। প্রয়োজনে তাদের কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে। সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ।

আপনার মতামত জানান