শিক্ষকের প্রতি বিভাগীয় কমিশনারের শ্রদ্ধা নিবেদন

প্রকাশিত


সোনারগাঁয়ে সম্ভুপুরা ইউনিয়নের নবীনগর গ্রামের সন্তান ১৯৯৮ সালে প্রয়াত বিএম ইউনিয়ন হাই স্কুলের আদর্শবান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বিএসসির কবরস্থানে পুস্পার্ঘ অর্পন শেষে বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন তাঁরই কৃতিছাত্র বর্তমানে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মোঃ খলিলুর রহমান। শিক্ষাগুরুর প্রতি কৃতি ছাত্রের গভীর শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালবাসার এ এক অপূর্ব নির্দশন।


সুদীর্ঘ সময় পরেও শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের এমন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বর্তমান প্রজন্মের নিকট একটি অনুকরণীয় শিক্ষা বলে মনে করেন সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ্, সোনারগাঁয়ের ইউএনও আতিকুল ইসলাম, এসিল্যান্ড গোলাম মুস্তফা মুন্না প্রমূখ। 


কমিশনারের ওয়াল থেকে প্রাঞ্জল লেখায় ফুটিয়ে তোলা একজন গুনী শিক্ষকের সহজ সরল গৌরবোজ্জ্বল জীবনীর লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
“আমার শিক্ষক, শ্রদ্ধেয় নূরুল ইসলাম বিএসসি। চিরকুমার, নির্ভীক, চরম নীতিবান, কর্তব্যপরায়ন, অধ্যবসায়ী, একজন আদর্শবাদী মানুষ।


নূরুল ইসলাম স্যার ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি সোনারগাঁও উপজেলার নবীনগর গ্রামে জন্মে ছিলেন । তিনি হোসেনপুর উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিকুলেশন ও হরগঙ্গা কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে বিএম ইউনিয়ন হাই স্কুলে বিএসসি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক ও কিছু দিন প্রধান শিক্ষক(ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ৩৫ বছর দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৮৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর এ স্কুল থেকে শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তি টানেন। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি একদিনও অসুস্থতার জন্য বা অন্য কোন কারণে স্কুল কামাই করেন নি। তার নিজ বাড়ি হতে দীর্ঘ ৪ কিলোমিটার পারি দিয়ে অর্থাৎ আসা যাওয়া ৮ কি.মি পথ পায়ে হেটে তিনি তার শিক্ষকতার জীবন চালিয়ে গেছেন। শীত-গ্রীষ্ম সকল ঋতুতেই তার সঙ্গী ছিল ছাতা। পথে দেখা হলে সালাম বিনিময়ের পর ‘কী হে বাপু’ সম্ভোধনটি ছিল চিরায়ত।

তিনি ছিলেন অনন্য রাজনৈতিক শুদ্ধাচারী; চরম মুজিবভক্ত মানুষ। জাতির পিতার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভক্তি। বঙ্গব্ন্ধু সম্পর্কে কোন বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করার অর্থ ছিল স্যারকে ক্ষেপিয়ে দেয়া। শিক্ষক মিলনায়তনে বিতর্ক মানেই স্যারের সাথে কারও তর্ক; বিষয় বঙ্গবন্ধু। তাকে ক্ষেপানোর জন্য কেউ তাঁকে খোঁচা দিতে পারে তা তিনি বুঝতে চাইতেন না। নির্বাচনে রাজনৈতিক মতদ্বৈততার কারণে তিনি কখনও তাঁর চাচার পক্ষে কাজ করেন নি, বরং তার বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল সাবদি গ্রামে। এ সময় তিনি এ মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁর বাড়িতে রেখে আপ্যায়ন করাতেন। তিনি বীরমু্ক্িক্তযোদ্ধাদের আগলে রাখতেন পিতৃস্নেহে। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর একদল মুক্তিযোদ্ধা পুরাণবন্দরে ব্লকে পড়ে যায়, নদী পাড় হওয়ার সময়, তিনি সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে তাদের নিয়ে এসে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

তাঁকে একজন ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে দেখেছি। আমাদের ধর্মীয় শিক্ষক নূর মোহাম্মদ স্যারের নিয়োগ কালে তাঁর বিষয়ে একটি আপত্তি উঠে। নূর মোহাম্মদ স্যার জবাবে বলেছিলেন, ‘ক্লাশে পড়াব আমি, ….. পড়াবে না’। এ ব্যাপারে বিএসসি স্যার তাঁকে সমর্থন করে ছিলেন। স্যারের চাকুরি হয়েছিল। নূর মোহাম্মদ স্যার একজন সফল শিক্ষক হয়েছিলেন। তাঁর সময়ে ইসলামিয়াতে অনেকে লেটার পেয়েছে। তবে এ কারণে তিনি মজা করে নূর মোহাম্মদ স্যারকে ডাকতেন ‘…. মাওলানা’ বলে। নূর মোহাম্মদ স্যার তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন।

তিনি সারা জীবন সময়মত স্কুলে আসতেন, স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে যেতেন।

জীবনে কোন দিন প্রাইভেট পড়ান নি। কোন ছাত্র কোন বিষয় বুঝতে চা্ইলে বুঝিয়ে দিতেন। দুষ্টু ছাত্রদের নিকট তিনি ছিলেন কড়া শিক্ষক।
স্কুল খোলার দিন দুপুরে লাঞ্চ হিসেবে তিনি ক্রীড়া শিক্ষক গোপাল স্যারের সাথে চিড়ে জাতীয় খাবার গ্রহণ করতেন। খুবই সাধারণ একটি খাবার মেন্যু। সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে আসতেন, আবার বাড়িতে গিয়ে রাতের খাবার খেতেন। কোনো দিন কোনো হোটেলে তাকে দেখা যায় নি। ইত্তেফাক পত্রিকাটি তিনি অনেক সময় নিয়ে পড়তেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়গুলো তার পছন্দের বিষয় ছিল। সকল শিক্ষকদের সাথে তাঁর ছিল অনন্য সম্পর্ক। বিশেষ করে আব্দুল হাই স্যার তার ছাত্র ছিলেন। তাকে ডাকতেন বাঁ…. ইত্যাদি বলে। তিনি আজীবন হাই স্যারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। হাই (নাট্যব্যক্তিত্ব) স্যারের অপরাধ ছিল, তিনি নাটক করে বেড়াতেন। আর নূরুল ইসলাম স্যার প্রচন্ড নাটক বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বিধিবাম স্যারকে একসময় স্কুলের নাটক কমিটির প্রেসিডেন্ট করা হয়। তাঁর সভাপতি থাকা কালকে বলা হয় স্কুলের নাটকের সুবর্ণ সময়। তাঁর সময়ের অন্যতম সাফল্য হল, তিনি প্রধান শিক্ষক যোগেন স্যারকে নাটকে অভিনয় করতে রাজি করিয়েছিলেন। যোগেন স্যারের বিচারকের অভিনয়টি আজও আমি কল্পনায় দেখতে পাই।বিএসসি স্যারের অন্যতম নাট্যপ্রযোজনা ‘ডাকঘর’ নাটক।

১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার্থীদেরও তিনি বিশেষ সুযোগ দেননি। যে কারণে তাকে অপদস্থ হতে হয়েছিল, কিন্তু তিনি মাথা নত করেন নি। পরবর্তী জীবনে কী কারণে যেন তিনি এসএসসি পরীক্ষায় পরীরক্ষকের (ইনভেজিলেটর) দায়িত্ব ছেড়ে দেন। শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে তিনি তার পৈত্রিক জমিতে ফসল ফলাতেন। তাঁর পৈত্রিক জমির পরিমাণ কমবেশি ৮ একর ছিল। তিনি নিজেকে একজন অগ্রসর কৃষক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা শুনতে চাইলে তিনি তাঁর তিন দুষ্ট ছাত্রের পথ রোধের কথা উল্লেখ করে সে ঘটনাটি আমাদেরকে বলেছিলেন। তবে তাদের উদ্দেশ্য যাই থাক, তারা স্যারের সামনে এসে, তার নির্ভিক ব্যক্তিত্বের কাছে মৃয়মান হয়ে পড়েছিল। এটাই স্বাভাবিক। ১৯৯৯ সালের ৮ডিসেম্বর এ আদর্শবান মানুষটি সারা জীবনে ছড়িয়ে দেয়া অনুকরণীয় আদর্শ স্মৃতি করে দিয়ে লোকান্তরিত হন। মৃত্যুকালে তিনি তার আদর্শের অজস্র উত্তরসূরি রেখে গেছেন।”

আপনার মতামত জানান