লৌহ ও কলম আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি
সৃষ্টিজগতের আদি-অন্ত, শুরু-শেষ সব তথ্য একত্রে সংরক্ষিত রাখার জন্য মহান আল্লাহ লৌহ ও কলম সৃষ্টি করেছেন। এ দুটি বস্তু আল্লাহর বৃহৎ ও বিস্ময়কর সৃষ্টি। লৌহ মানে লাওহে মাহফুজ। লাওহে মানে ফলক।
মাহফুজ অর্থ সংরক্ষিত। লাওহে মাহফুজ অর্থ সংরক্ষিত ফলক। ইসলামী পরিভাষায় লাওহে মাহফুজ হলো, ঊর্ধ্ব আকাশে সংরক্ষিত ফলক, যার মধ্যে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ অবধি সব কিছু মহান আল্লাহ লিখে রেখেছেন। ওই ফলকে আল্লাহ তাআলা সব সৃষ্টির তাকদির লিপিবদ্ধ করেছেন। পবিত্র কোরআনও সর্বপ্রথম ওই ফলকে লিপিবদ্ধ ছিল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বরং এটা মহান কোরআন। লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ। ’ (সুরা বুরুজ, আয়াত : ২১-২২)
পৃথিবীর আদি-অন্ত, শুরু-শেষ সব কিছু লেখা আছে লাওহে মাহফুজে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তুমি কি জান না যে আল্লাহ জানেন যা কিছু আকাশে ও ভূমণ্ডলে আছে। এসব কিতাবে লিখিত আছে। আর এটা আল্লাহর কাছে সহজ। ’ (সুরা হজ, আয়াত : ৭০)
লাওহে মাহফুজের ধরন সম্পর্কে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, লাওহে মাহফুজের দৈর্ঘ্য আসমান-জমিনের সমান আর প্রস্থ পূর্ব-পশ্চিমের সমান। আর তা নির্মিত হয়েছে সাদা মণিমুক্তা দ্বারা। (তাফসিরে ইবনে কাসির : খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৯৮)
মহান আল্লাহর নির্দেশে বিশেষ কলম ওই ফলকে লিপিবদ্ধ করে। উবাদা ইবনে সামেত (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি তাকে বলেছেন, লিখো। কলম বলল, হে আমার রব, কী লিখব? আল্লাহ বলেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি বস্তুর তাকদির লিপিবদ্ধ করো। (তিরমিজি, হাদিস : ২১৫৫)
হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা ধবধবে সাদা মণিমুক্তা থেকে লাওহে মাহফুজ সৃষ্টি করেছেন, তার পৃষ্ঠদেশ লাল ইয়াকুত পাথরের। তার কলম নুর, লেখা নুর। আল্লাহ প্রতিদিন তাতে ৩৬০ বার দৃষ্টি প্রদান করেন। প্রতি দৃষ্টিতে তিনি সৃষ্টি করেন, রিজিক দান করেন, মৃত্যু দেন ও জীবন দেন, সম্মানিত করেন ও অসম্মানিত করেন। তিনি যা চান তা-ই করেন। ’ (তাবরানি, হাদিস : ১২৫১১)
সব কিছু লেখার পর কলম শুকিয়ে গেছে
পবিত্র কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা কলমের কসম করেছেন। তিনি বলেন, ‘শপথ কলমের এবং সেই বিষয়ের, যা তারা লিপিবদ্ধ করে। ’ (সুরা কলম, আয়াত : ১)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর যে বিশ্বাসী অবস্থায় সত্কর্ম সম্পাদন করে, তার প্রচেষ্টা অস্বীকৃতি হবে না এবং আমি তা লিপিবদ্ধ করে রাখি। ’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৯৪)
জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, সুরাকা বিন মালিক বিন জুশাম রাসুল (সা.)-এর কাছে এলেন। অতঃপর বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের দ্বিনের ব্যাখ্যা দিন। যেন এখনই আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। আজকের আমল কী? কলম যা লিখে শুকিয়ে গেছে এবং তাকদির যে বিষয়ে অবধারিত হয়ে গেছে, তাতেই আমরা আমল করব, নাকি ভবিষ্যতের কোনো বিষয়ে আমল করব? তিনি বলেন, না; বরং যা লিখে কলম শুকিয়ে গেছে এবং যে ব্যাপারে তাকদির নির্ধারিত হয়ে গেছে, তা-ই তোমরা আমল করবে। (মুসলিম, হাদিস : ২৬৫৩)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একদা আমি নবী করিম (সা.)-এর পেছনে ছিলাম। তিনি বলেন, হে বালক, আমি কি তোমাকে কিছু শেখাব না? তুমি আল্লাহ (আল্লাহর বিধি-বিধান)-কে সংরক্ষণ করো, তিনি তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহর বিধি-বিধানের সুরক্ষায় সচেষ্ট হও, তুমি তাকে তোমার কাছে পাবে। যখন প্রার্থনা করবে, আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে। আর যখন সাহায্য চাইবে, আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। জেনে রেখো, কোনো বিষয়ে তোমার উপকারার্থে যদি গোটা মানবজাতি একত্র হয়, তবে তারা তোমার কোনোই উপকার করতে পারবে না। শুধু তা-ই হবে, যা আল্লাহ তাআলা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এবং যদি তারা সবাই কোনো বিষয়ে তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্র হয়, তাহলেও তারা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তবে তাই করতে সক্ষম হবে, যা আল্লাহ তোমার বিপক্ষে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, লিপিকা শুকিয়ে গেছে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৬)
উল্লিখিত হাদিস ও অন্যান্য হাদিসে ‘আল-আকলাম’ শব্দটি বহুবচনরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, প্রথম কলম ছাড়া তাকদিরের জন্য একাধিক কলম আছে।
কলমের প্রকারভেদ
বিভিন্ন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে কলম চার প্রকার।
প্রথম প্রকার : ব্যাপক ও সমগ্র সৃষ্টিকে শামিল করে।
দ্বিতীয় প্রকার : যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কলমও ব্যাপক, তবে শুধু বনি আদমের জন্য। এ বিষয়ে কিছু আয়াত বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো প্রমাণ করে যে আল্লাহ তাআলা মানুষের কর্ম, রিজিক, হায়াত ও সৌভাগ্য নির্ধারণ করেছেন, তাদের পিতা আদম (আ.)-এর সৃষ্টির পরই।
তৃতীয় প্রকার : মাতৃগর্ভে থাকাকালীন বাচ্চার কাছে যখন ফেরেশতা প্রেরণ করা হয়, অতঃপর সে তার মধ্যে রুহ সঞ্চার করে এবং তাকে চারটি বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয় : রিজিক, হায়াত, আমল ও নেককার অথবা বদকার হওয়ার কথা লিখা হয়।
চতুর্থ প্রকার : প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বান্দার ওপর নিয়োজিত কলম, যা কিরামান কাতেবিনের হাতে থাকে। বনি আদম যা করে, তারা তা লিপিবদ্ধ করেন। (আকিদাতু ত্বাহাবি : ১৩৮ পৃষ্ঠা, বাংলা সংস্করণ)
আপনার মতামত জানান