রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা করে ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা দেয় তিনজন

প্রকাশিত

নিউজ ডেক্স: ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত শেষে আগামীকাল বুধবার ফেনীর আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করবে পুলিশ ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

দেশব্যাপী আলোচিত এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলাসহ ১৬ জন জড়িত।

যারা অভিযুক্ত হচ্ছে তারা সবাই এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের ১২জন আদালতে ৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। পিবিআই মাত্র ৪৮ দিনের তদন্তের এই খুনের অদ্যপান্ত বের করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যৌন নিপীড়নের ঘটনায় সিরাজের বিরুদ্ধে মামলার করার মাধ্যমে প্রতিবাদ করার কারণেই নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যা করা হয়। এতে আসামিদের স্বার্থে আঘাত হানে। মামলা করার কারণে সিরাজ ও তার সহযোগীরা ক্ষুব্ধ হয় এবং অপর স্বার্থ সংশ্লিষ্টরা এতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। শিক্ষার্থী রাফিকে কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে শরীরে আগুন দেয় পাঁচজন।

এরা সবাই অধ্যক্ষ সিরাজের অনুসারী। তাদের তিনজন নুসরাত রাফির সঙ্গেই আলিম পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতা, একজন শিক্ষক, সিরাজের সাবেক ছাত্রসহ বাকি ১০জন টাকা দিয়ে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সহায়তা করে।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ইউনিটের প্রধান উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার তদন্তের সবশেষ অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে আগামীকাল আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। এই মাসলাটি তদন্ত করতে গিয়ে যতই ভেতরে ঢুকেছি ততই আমাদের কষ্ট বেড়েছে। কেবল শাবালিকা হয়েছে এমন একটা মেয়েকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে, এ মামলার আসামিরা কেউ ছাড় পাবে না। বিচার চলাকালে আদালতে সব আসামি উপস্থিত থেকে নিজ চোখে তাদের বিচার দেখবে। আমরা পেরেছি। ঘটনায় অভিযুক্ত প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা উল্লেখ করে মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে।

তদন্তের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বনজ কুমার বলেন, ১০ এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার আমরা পাই। ১১ তারিখে প্রথমেই আমরা গ্রেপ্তার করি স্থানীয় কাউন্সিলার মাকসুদ আলমকে। এর পর একে একে অন্যদের গ্রেপ্তার করি। আমরা যে সুনির্দিষ্ট ১৬ জনকে এই ঘটনায় এরেস্ট দেখিয়েছি এই ১৬ জনকেই আমরা মৃত্যুদণ্ড চাইবো। এদের প্রত্যেককেই আমরা কয়েক দফায় রিমান্ডে এনেছি। সবচেয়ে বেশি রিমান্ডে এনেছি সিরাজ উদ দৌলাকে। তাকে তিন বার রিমান্ডে এনেছি। ১২ আসামিরা ছাড়াও ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে সাত জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আসামিরা সিরজ উদ দৌলার সঙ্গে কারাগারে দেখা করে নির্দেশনা নিয়ে আসে। নির্দেশনা নিয়ে আসার পর টিনসেটের হোস্টেলে তারা প্রথমে সিরাজ উদ দৌলার মুক্তি কমিটি করে। ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন নুর উদ্দিন এবং যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন শাহদত হোসেন শামীম। পরর্তীতে তারা পরিকল্পনা করে কে কোথায় থাকবে। গেট পাহারা দিছে একজন। একজন পাহাড়া দিছে সাইক্লোন সেন্টার। তিনি বলেন, নুসরাত যখন ছাদে যায় তখন মামলা তুলতে একটা সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। এখানে ৫ জন বোরখা পরে অংশ নেয়। তাদের দুই জন মেয়ে। উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ও কামরুন নাহার মনি। তারা কাগজে স্বাক্ষর করতে পেশার দেয়। এতে নুসরাত প্রথমে কনফিউজ হয়ে যায়। কিন্তু সে রাজি না হলে শামীম পপিকে বলে বোরকার মধ্য থেকে ওড়না বের করে নিতে। সে ওড়না বেড় করে নিয়ে জোবায়েরকে দেয়। জোবায়ের এক পাশ নিয়ে পা বাধতে যায়। আর পপি পেছনে হাত বাধে। এরপর তিন জন মিলে শুইয়ে ফেলে। শামীম মুখ চেপে ধরে। পপি ও জুবায়ের পা চেপে ধরে ওড়না দিয়ে গিট দেয়। একটি কাচের গ্লাস নিয়ে আসে। সেই গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের গায়ে দেওয়া হয়। আগুন দেওয়ার পর হাত ও পায়ের বাঁধন পুড়ে গেলে সে নিচে নেমে আসতে পারে।

তিনি আরো বলেন, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়াদের মধ্যে দুই জন মেয়ে সামনে থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে পরীক্ষার হলে ঢোকে। আরেকজন পরীক্ষার্থী ছিলো জাবেদ। সেও পাস দিয়ে নেমে পরীক্ষার হলে যায়। সে পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে বোরখা দিয়ে যায় শামীমকে। শামীম মুল গেট দিয়ে না গিয়ে পেছন দিয়ে বাথরুমের পাশ দিয়ে হোস্টেলের পাশ বের হয়ে যায়। জোবায়ের অত্যন্ত সাহসী। সে বোরখা পরে ঘুরে মেইন গেটে আসে। সেখান দিয়ে একজন মেয়ে হিসেবে সে বেরহয়ে পাশেই কৃষি ব্যাংকের সিড়িতে উঠে বোরখা ও হাতমোজা চেঞ্জ করে।

মাদরাসার ইংরেজি শিক্ষক আবছার উদ্দিন ঘটনার সময় তিনি গেট পাহারার দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও আগের মামলার বাদিকে (নুসরাতের মা) ফোন করে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন তিনি।

কামরুন নাহার মনিকে দুই হাজার টাকা দিয়ে বোরখা ম্যানেজ করতে বলেন শামীম। এ টাকায় দু’টি বোরখা ও হাতমৌজা কেনেন। কেনা দুটি বোরখাসহ তার নিজের কাছ থেকে একটি মিলিয়ে মোট তিনটি বোরখা ওই ভবনের তৃতীয় তলায় রেখে আসেন। ছাদে ওঠানোর পর নুসরাতকে শুইয়ে ফেলতে সহায়তা করেন এবং বুকের উপর চাপ দিয়ে ধরে রাখেন। ঘটনার পর ঠাণ্ডা মাথায় এসে তিনিও পরীক্ষায় অংশ নেন।

প্রসঙ্গত, ২৭ মার্চ সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে ছাত্রী রাফিকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করে তার মা। এতে পুলিশ সিরাজকে গ্রেপ্তার করে। ৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে গেলে রাফিকে সাইক্লোন শেল্টার ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় সিরাজের সহযোগীরা। ৮ এপ্রিল তার ভাই সিরাজকে প্রধান আসামি করে আট জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে রাফির মৃত্যু হয়। ওই দিনই হত্যার ধারায় যুক্ত মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় পিবিআইকে।

আপনার মতামত জানান