যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নেতিবাচক দিক দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে

প্রকাশিত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
বিশ্বব্যাপী যোগযোগ ও নেটওয়ার্ক তৈরিতে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভার এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। কিন্তু এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নেতিবাচক দিক দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। উঠতি বয়সি কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বুঁদ হয়ে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাদের দিনের বড় একটা সময় পার হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব প্ল্যাটফরমে। করোনা মহামারির কালে এটি বড় ধরনের আসক্তির আকার ধারণ করে নানা শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে হয়রানি, প্রতারণা, নারী নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। অনেকে আবার নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছে নানা অনৈতিক সম্পর্ক ও অপরাধে। সেখানে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অশালীন, অপ্রীতিকর ছবি, ভিডিও। শুধু তাই নয় অনেকে দেশদ্রোহী নানা কাজেও ব্যবহার করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন, প্রতারণা, আত্মহত্যাসহ নানা ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মনোবিজ্ঞানী মেহতাব খানম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ড্রাগসের চেয়েও সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আসক্তি মারাত্মক হয়ে যাচ্ছে। এখানে সম্পর্কগুলো দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। সহজেই একজনের সঙ্গে আরেকজনের যোগাযোগ হচ্ছে। এ কারণে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, একাধিক সম্পর্ক বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ফেসবুকে এমন কিছু দেখছে যা তাদের ওপর প্রভাব ফেলছে, হতাশও হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, ড্রাগের আসক্তির চেয়েও সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে এটা। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়ে আমরা যথেষ্ট শিক্ষা গ্রহণের আগেই সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসছে। দায়িত্বশীল ব্যবহার করতে পারছি না এটির। সেখানে অজস্র সময় দেয়ার কারণে অন্য সব কিছুতে প্রভাব ফেলছে। মাথা ওটাতেই ব্যস্ত থাকছে।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা আসলে একটা বাচ্চাকে কোনো বিনোদন দিচ্ছি না। তার খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই, ক্লাব নেই, কমিউনিটি অ্যাকটিভিটি নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই। তো বাচ্চারা করবে কি? এখানে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অনেক দায়িত্ব রয়েছে। একাটি বাচ্চাকে মানসিক সুস্থতা নিয়ে বড় করার জন্য বাচ্চার বাবা-মায়ের জন্য প্যারেন্টিং শিক্ষাটাও অনেক বড় ব্যাপার। প্যারেন্টিংয়ের কোনো কোর্স, ওয়ার্কশপ আমাদের নেই। সত্যি বলতে বাচ্চাদের বিকল্প কিছু না দিলে এ অবস্থা থেকে উন্নতি সম্ভব নয়। ওদেরকে ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। মাহতাব খানম আরও বলেন, এখানে বাবা-মায়ের পাশাপাশি স্কুলগুলোর অনেক বড় দায়িত্ব রয়েছে। একটা বাচ্চা কুঁড়ির মতে স্কুলে আসে। তাকে মানুষ হিসাবে তৈরি করা আসলে স্কুলের কাজ। শুধু ভালো পড়াশোনা করানোই স্কুলের কাজ না। বাচ্চার সব ধরনের ডেভেলপমেন্ট ইনশিওর করতে হবে।

দেশে ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। বারবার সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন নারীরা। জঙ্গিরাও এই মাধ্যম ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ ও নানা হুমকি দিচ্ছে। জঙ্গিবাদ এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর অভিযোগে কয়েক মাস আগেও ফেসবুকের ৩০টি পেজ ও আইডিকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিট।

গত বছর সিংড়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সিংড়ায় এক আয়োজনে বলেছিলেন, দেশে যত সাইবার অপরাধ হয়, তার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ কিশোরী এর শিকার হচ্ছে। সাইবার অপরাধে শিকার হওয়া কিশোরীদের মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কেউ যদি এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়, তাহলে ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা নিতে পারে।

ফেসবুকের চ্যাট বা ভিডিও চ্যাটের ছবি একটু এদিকে-সেদিক করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিডিওচিত্র ফেসবুক, ইউটিউবে অথবা বিভিন্ন পর্নো সাইটে শেয়ার করা, ভিউ বাড়ানোর জন্য আপত্তিকর শিরোনাম কিংবা থাম্বনেইলে অশ্লীল ছবি ব্যবহার করা এরকম নানা অযাচিত সমস্যায় পড়তে হয় মেয়েদের।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নানা দিক তুলে ধরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, জীবন রক্ষাকারী ওষুধেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। ভালোটার পাশাপাশি খারাপটা আসবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। আমরা যেহেতু দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছি সেহেতু এর ভালোটার পাশাপাশি খারাপটাও আসছে। আমাদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থাটি বহু রাষ্ট্রের সঙ্গে মিল নেই। এখানে জঙ্গিবাদের বিস্তার আছে, নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা আছে, দেশদ্রোহী মানুষ আছে, পাকিস্তানের দালাল আছে। এদের রাজনীতিও এখন রাস্তার পরিবর্তে চলে গেছে ফেসবুক, ইউটিউবে। এখন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে এসব কার্যক্রম করা যাচ্ছে। আরেকদিক থেকে আমাদের দেশে যে পরিমাণ ডিজিটাইজ হয়েছে সেই পরিমাণ সচেতনতা তৈরি হয়নি। ফলে এটা অনেক ক্ষেত্রে বিদজ্জনক জায়গা হয়ে গেছে। এখানে মেয়েদের হয়রানি করা হয়, প্রতারণা করা হয়। কমন যে অপরাধগুলো ছিল সেগুলো ডিজিটাল অপরাধেও উন্নীত হয়েছে। এ অপরাধগুলো আমাদের ডিজিটাল জীবনের বাইরেও অবস্থান করে।

অনেকেই ফেসবুক বা নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে এ প্রযুক্তিবিদ বলেন, ডিজিটাল দুনিয়াতে আসলে নানা কায়দায়ই এগুলোকে ব্যবহার করা যায়। সেক্ষেত্রে আমরা আসলে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি বেশি বেশি সচেতনতা বৃদ্ধিতে। উন্নত দেশগুলোতে এ অপরাধগুলো আমাদের মতো নেই। কারণ, তারা ইন্টারনেটের দুনিয়ায় বসবাস করে বহু আগে থেকে। তাদের সচেতনতার পর্যায়টি পরিবারের অভিভাবক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমরা যেহেতু একটু দেরিতে শুরু করেছি তাই এটা হতে হতে কিছুটা সময় লাগবে। অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর তারা নতুন আইন করেছে সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য। আমরাও হয়তো সেটাই করব। নতুন আইন করে সোশ্যাল মিডিয়া যেগুলো আছে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যা করা দরকার তা করব।

সূত্রঃ যুগান্তর

আপনার মতামত জানান