মুয়াবিয়া (রা.)-এর জন্য মহানবী (সা.) যে দোয়া করেন
মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) মহানবী (সা.)-এর একজন সম্মানিত সাহাবি ও ইসলামী ইতিহাসের সোনালি যুগের একজন সফল শাসক। নবুয়তের পাঁচ বছর আগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সপ্তম হিজরিতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১১/৩৯৬)
রাসুল (সা.)-এর সংশ্রব ও দোয়া : মুয়াবিয়া (রা.) মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সংশ্রব লাভ করেন। এই সময় তিনি হুনাইনের যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি সেই মর্যাদাবান সাহাবিদের অন্যতম, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসুল ও মুমিনদের প্রতি প্রশান্তি নাজিল করেন এবং এমন এক সেনাদল প্রেরণ করেন, যা তোমরা দেখতে পাওনি। তিনি অবিশ্বাসীদের শাস্তি দেন। এটা অবিশ্বাসীদের কর্মফল।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ২৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) মুয়াবিয়া (রা.)-এর জন্য দোয়া করেন। তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, মুয়াবিয়াকে কিতাব ও হিসাব শিক্ষা দিন। তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন।’ (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ৩৩৬৫৬)
মুয়াবিয়া (রা.) মোট ১৬৩টি হাদিস বর্ণনা করেন। যার মধ্যে চারটি সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম উভয় গ্রন্থে এসেছে। পৃথকভাবে ইমাম বুখারি (রহ.) চারটি ও ইমাম মুসলিম (রহ.) পাঁচটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। (সিয়ারুল আলামুন নুবালা : ৩/১৬২)
সাহাবিদের চোখে মুয়াবিয়া (রা.) : মুয়াবিয়া (রা.) সম্পর্কে সাহাবিদের বড় একটি অংশ উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। তাদের মন্তব্য ও মূল্যায়ন থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক মতভিন্নতা ও ইজতিহাদি মতবিরোধ তাঁর সততা ও ন্যায়পরায়ণতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় মুবায়িবার চেয়ে বেশি উত্তম আখলাকের পরিচয় দিতে কাউকে দেখিনি।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১১/৪৩৯)
ব্যক্তিগত গুণাবলি ও জ্ঞানচর্চা : ইসলাম গ্রহণের আগে মক্কার সীমিতসংখ্যক শিক্ষিত মানুষের একজন ছিলেন তিনি। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অবিচ্ছিন্ন সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর ‘কাতিব’ (ওহি লেখক) মনোনীত হন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁকে ‘ফকিহ’ (ইসলামী আইনজ্ঞ) আখ্যা দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৭৬৪; আন নিহায়া আনিত তানি আমিরিল মুমিনিনা মুয়াবিয়া, পৃষ্ঠা ৪১)
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সহনশীল, বিচক্ষণ, বিনয়ী, আল্লাহভীরু ও কল্যাণকামী। (সহিহ আলবানি, হাদিস : ১৭১৩)
চার খলিফার যুগে প্রশাসনিক দায়িত্ব : ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর যুগে মুয়াবিয়া (রা.) বিভিন্ন যুদ্ধ ও সেনা অভিযানের নেতৃত্ব দিলেও তাঁর প্রথম প্রশাসনিক নিয়োগ হয় ওমর (রা.)-এর যুগে। ১৫ হিজরিতে তিনি তাঁকে কায়সারিয়ার (ফিলিস্তিনের নিকটবর্তী একটি উপকূলীয় শহর) শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। দীর্ঘ অবরোধের পর মুয়াবিয়া (রা.) এই শহর জয় করেন। ১৮ হিজরিতে দামেস্কের শাসক ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-এর মৃত্যু হলে ওমর (রা.) মুয়াবিয়া (রা.)-কে ভাইয়ের স্থলাভিষিক্ত করেন। (তারিখে তাবারি : ৪/৪৩১; তাবাকাতুল কুবরা : ৭/৪০৬)
উসমান (রা.) খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ওমর (রা.)-এর যুগের অন্য গভর্নর ও শাসকদের মতো মুয়াবিয়া (রা.)-কে স্বপদে বহাল রাখেন। তবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাঁর শাসনাধীন অঞ্চলের আয়তন বৃদ্ধি করা হয়। (তারিখে তাবারি : ৫/৪৪২; আল ওলায়াতু আলাল বুলদান : ১/১৭৬)
উসমান (রা.) শহিদ হওয়ার পর আলী (রা.) তাঁকে শামের গভর্নর পদ থেকে অব্যহতি দেন এবং তাঁর হাতে আনুগত্যের শপথ করার আহ্বান জানান। কিন্তু উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি তা করতে অস্বীকার করেন। তবে আলী (রা.) বেঁচে থাকতে তিনি কখনো নিজেকে খলিফা দাবি করেননি।
হাসান ইবনে আলী (রা.)-এর সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার পর তিনি খেলাফতের বাইআত গ্রহণ করেন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘মুয়াবিয়া (রা.) খেলাফতের দাবি করেননি, আলী (রা.) শহিদ হওয়ার আগে তিনি খলিফা হিসেবে নিজের আনুগত্যের শপথও নেননি। তিনি আলী (রা.)-এর তুলনায় খেলাফতের বেশি যোগ্য ছিলেন না। তিনি তা স্বীকার করতেন। কেউ এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি আলী (রা.)-এর যোগ্যতার ব্যাপারে স্বীকারুক্তিও দিতেন।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া : ৩৫/৭২)
গভর্নর হিসেবে অবদান : ওমর (রা.) কর্তৃক নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে আলী (রা.)-এর শাহাদাতের আগ পর্যন্ত মুয়াবিয়া (রা.) সময় পর্যন্ত ওয়ালি বা গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওমর (রা.)-এর যুগে রোমান সাম্রাজ্যের আরব অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই মুসলিম শাসনাধীন হয়। শামের সঙ্গে রোমের শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত ছিল। ফলে তারা এই পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। রোমানরা শামের উপকূলীয় অঞ্চলে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে লুটপাট চালাত। মুয়াবিয়া (রা.) বিশাল এই সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। উসমান (রা.)-এর অনুমতিতে তিনি নৌ বাহিনী গঠন করেন। মুয়াবিয়া (রা.)-এর নির্দেশে হাবিব বিন সালামা ফিহরি (রা.) আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া বিজয় করেন। এ ছাড়া ইরাকের পার্শ্ববর্তী শামশাত, মিলতিয়য়া প্রভৃতি দ্বীপ জয় করেন। (হুরুবুল ইসলাম ফিশ-শাম ফি উহুদিল খুলাফায়ির রাশিদিন, পৃষ্ঠা ৫৭৭)
মুয়াবিয়া (রা.)-এর নির্দেশে উবাদা বিন সামিত (রা.)-এর নেতৃত্বে সাইপ্রাসে অভিযান চালানো হয় এবং সাইপ্রাস রোমান সাম্রাজ্যের পরিবর্তে খেলাফতের আনুগত্য মেনে নেয়। (তারিখুত তাবারি : ৫/২৬১)
জনগণের সেবা : শাসক হিসেবে মুয়াবিয়া (রা.) ছিলেন প্রজাহিতৈশী। মানুষের সেবা ও কল্যাণে তাঁর অসংখ্য কাজের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি মসজিদুল হারামের সম্প্রসারণ করেন, তাওয়াফকারীদের যেন কষ্ট না হয় সে জন্য মমবাতি, জ্বালানি তেল বরাদ্দ দেন। মসজিদুল আকসার উন্নয়নমূলক কাজ করেন। মিসরের ফুসতাস জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। কুফা ও বসরা জামে মসজিদ সম্প্রসারণ করেন। এ ছাড়া বিজিত অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে মসজিদ নির্মাণের সাধারণ অনুমতি দেন। (দিরাসাতু ফি তারিখিল খুলাফায়ি আল উমাভি, পৃষ্ঠা ৩৪৭; তারিখুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৪২৬-২৭)
অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা, কৃষির উন্নয়ন : মুয়াবিয়া (রা.) তাঁর শাসনাধীন অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি রাষ্ট্রের কৃষি, ব্যবসা ও শিল্পব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পরই তিনি শামের উর্বর ভূমিতে কৃষি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শামে একাধিক খাল খনন করেন এবং অনাবাদি জমি আবাদে বিশেষ প্রণোদনা দেন। ফলে শামের রাজস্ব পাঁচ বিলিয়ন দিরহামে উন্নত হয়। (ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ২৯১)
উল্লেখযোগ্য বিজয় ও তার প্রভাব : মুয়াবিয়া (রা.)-এর যুগে মুসলিম বাহিনী মিসরের রাওদা দ্বীপ, রোডস, আরওয়াদ, জিরবা দ্বীপ, বাইজার্ত, কিরওয়ান, সোসি, সিরত, মিকদাস, ওয়াদ্দান ও ভূ-মধ্যসাগরের দ্বীপপুঞ্জ মুসলিম বাহিনী অধিকার করে। এ ছাড়া তারা কুহিস্তান, সিজিস্তান, তাখারিস্তান জয় করে জাইহুন তীরবর্তী বুখারা শহর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পর্তুগাল থেকে চীন পর্যন্ত এবং আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ৬৫ লাখ বর্গমাইল বিস্তৃত অঞ্চল তাঁর শাসনামলে ইসলামের পতাকাতলে চলে আসে।
মৃত্যু ও অসিয়ত : ৬০ হিজরির রজব মাসে মুয়াবিয়া (রা.) ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তিনি ইয়াজিদকে মুসলিম উম্মাহর রক্তপাত বন্ধের অসিয়ত করেন। (তারিখুত তাবারি : ৬/২৪১ ও ২৪৫)
সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ।
আপনার মতামত জানান