মি: চিন এর সফলতার গল্প বদলে দিতে পারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি

প্রকাশিত

 

মিঃ সাফুনোপানিচ (মিঃচিন) ১৯১০ সালে ২৪ জুন থাইল্যান্ডের এক গরীব এলাকায় জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতা এক কাঠের কারখানায় একজন কেরানী  হিসাবে কাজ করতেন। তিনি পাঁচ বছর বয়সে থাইল্যান্ড ত্যাগ করেন এবং চীনের এক দারিদ্র পীড়িত অঞ্চলে ১২ বছর বাস করেন। তার পরিবারের সদস্যরা কোন সময়ই প্রয়োজনীয় খাবার যোগাড় করতে পারত না।

মিঃ চিন মোট পাঁচ বছর স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন এবং এর অর্ধেক সময়ই ক্ষেতের কাজে ব্যয় করেন। চাষবাস এতো পরিশ্রম সাধ্য ছিল যে, সহজে মাটি কষনের জন্য বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হত। মিঃ চিন তাই বৃষ্টি হলে ক্লাশ ত্যাগ করে মাঠে চলে যেতেন।

পনের বছর বয়সে তিনি চীনের একজন গ্রামীন রসায়নবিদের  সঙ্গে শিক্ষা নবীশ হিসাবে কর্মরত হন। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের জটিল নাম তিনি খুব সহজেই আয়ত্ব করে ফেলেন। তার এই গুনে চমৎকৃত হয়ে মালিক তাকে চিকিৎসক হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু গ্রামীন চিকিৎসক না হয়ে তিনি স্কুলের শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর দুবছর পর তিনি চীন ছেড়ে থাইল্যান্ডে চলে আসেন এবং একটা কাঠের দোকানে বাবুর্চি হিসেবে চাকুরি নেন।

জীবন যাত্রা সে সময়ে এতো ব্যয়বহুল ছিল যে, বাড়তি উপার্জনের জন্য তার মূল দায়িত্বের পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করতে হত, যেমন: দোকান পরিস্কার করা, খদ্দেরের গাড়ীতে কাঠ তুলে দেয়া এবং কাঠ বিক্রির অন্যান্য কাজে মালিককে সাহায্য করা।

তিনি যা কিছু করেছেন সেটা তিনি উৎকৃষ্টভাবে করেছেন। শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতম করাটাই ছিল তার নেশা।  তাঁর মধ্যে সর্বোত্তম কার্য সম্পাদন করার গুন ছোট বেলা থেকেই লক্ষ্য করা যায়। এর প্রতিফলন তার পরবর্তী জীবনেও ঘটে যেখানে তিনি অন্যের চেয়ে ভাল করার জন্য সব সময়ই চেষ্টা করতেন।

এ সময় তার প্রখর স্মৃতি শক্তি লক্ষ্য করা যায়। কাঠের বিভিন্ন প্রকার এবং আকার হয়ে থাকে এবং বিভিন্ন কাঠের মূল্য এই প্রকার ও আকার ভেদে নির্ধারিত হয়ে থাকে। মিঃ চিন দোকানে সব জাতের কাঠ এবং এগুলোর মূল্য সহজেই মনে রাখতে পারতেন এবং প্রয়োজনে খদ্দেরকে সঠিক কাঠের দাম মাপ দেখেই নিজের মুখে মুখে হিসেব করে বলে দিতেন।

মিঃ চিনের এতোগুলো গুন দোকানের মালিককে মুগ্ধ করে ফেলে। এ সময় মালিক আরো লক্ষ্য করলেন যে মিঃ চিনের হাতের লেখাও খুব সুন্দর। এর পর পরই তিনি মিঃ চিনকে কেরানী  হিসেবে নিয়োগ করেন।

মিঃ চিন অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। তিনি অহেতুক লোক দেখানো খরচ অপছন্দ করতেন।  তার দৃষ্টিভঙ্গি সুদূরপ্রসারী ছিল। এ গুনের প্রমান পাওয়া যায় যখন তিনি একটি বিশেষ অনুদান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে নিজে বইয়ের দোকান দিলেন। উনি সব সময়ই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন এবং এ কারনে তিনি উচ্চাকাংখী ছিলেন।

বহুতল বিশিষ্ট বিক্রয় কেন্দ্রের পন্য সামগ্রী গুচ্ছাকারে সাজানোর কৌশল মিঃ চিনই প্রবর্তন করেন যা পরবর্তীকালে থাইল্যান্ডে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

জন্মের সময় এটা কেউ অনুমান করতে পারেন নাই যে একদিন তিনি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম ধনী ব্যক্তি হবেন এবং ব্যাংক ব্যবসায় এক বিরাট ব্যক্তিত্বে পরিনত হবেন। ব্যাংকক ব্যাংকের আজকের যে সমৃদ্ধি তা মিঃ চিনের উদ্যোক্তা সলুভ গুনাবলীর উৎকর্ষতাই প্রমান করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন শেষের পথে তখন তিনি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েন। মিঃ চিন ছিল তখন নবীন এবং ব্যাংকিং এর ব্যাপারে অনভিজ্ঞ এক যুবক। ব্যাংক ব্যবসায় অনেক টাকার লেনদেন হবে এ কথা ভেবে তিনি প্রথমে রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দেখা গেল ব্যাপারটি জটিল। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার শুরুটা ছিল অত্যন্ত পরিশ্রম সাথ্য এবং সফলতার জন্য শুধুমাত্র ভাগ্যের উপর নির্র্ভর করা যায়নি। মিঃ চিনের অধ্যবসায়, দক্ষতা, শক্তি এবং দূরদর্শিতাই ব্যাংক সফলতা এনে দিল।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে মিঃ চিন বুঝতে পারলেন যে, ব্যবসার অনেক সুযোগ তার হাতের কাছে। তিনি থাইল্যান্ডের প্রথম ফাইন্যান্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যা মূলত: বৈদেশিক মূদ্রা ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। এই কোম্পানিটি দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বিশ্বস্থ বৈদেশিক মুদ্রার একটি কোম্পানী হিসেবে নাম করে। মিঃ চিনকে এর জন্য প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা  কোম্পানীর  অফিসে আসার আগেই তিনি সকল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের হার জেনে নিতেন। বিনিময় হার সংগ্রহের জন্য তিনি খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে যেতেন। বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে তিনি পারদর্শী হয়ে উঠেন এবং এর কারনে তিনি থাইল্যান্ডে একজন সেরা বৈদেশিক মুদ্রার ডিলার হিসাবে পরিগণিত হয়ে যান।

এ সময় ব্যাংকক ব্যাংকের আর্থিক সংকট দেখা দিল। রিয়েল এস্টেট (গৃহ নির্মান) ব্যবসায় ব্যাংকের অধিক বিনিয়োগের ফলে নগদ অর্থের তীব্র সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তখন মিঃ চিনকে, যিনি ব্যাংকের একজন শেয়ার হোল্ডার ছিলেন, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা গ্রহন করতে অনুরোধ করেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি তার কোম্পানী (এশিয়া ট্রাষ্ট কো: লি:) থেকে  অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নিয়োগ করলেন।

তিনি দেখলেন যে, বিভিন্ন রকমের ব্যবসায়িক লেনদেনে হুন্ডি বা নগদ অর্থ লেনদেন করা হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে  ব্যাংকের ভূমিকা একেবারেই নগন্য। তাই তিনি তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ গুলোকে ব্যবহার করে  সরকার ও ব্যবসায়িক মহলকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, সকল প্রকার বৈদেশিক বানিজ্য,ঋণ ও অন্যান্য আর্থিক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করাটা সুবিধাজনক ও লাভজনক। তিনি তার বিশ্বস্ত সহকারী মিষ্টার রোজানাস্থীনকে ব্যংকের আর্থিক অবস্থা এবং ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করার দায়িত্ব দেন।

তাঁর নেতৃত্বে ব্যাংক অন্যান্য স্থানীয় ব্যাংক গুলোর মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে নিতে সক্ষম হয় এবং এখনো সেটা স্থানীয় এবং বিদেশী ব্যাংক গুলোর মধ্যে সেরা হয়ে আছে ।

তিনি বিদেশী কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ারের মালিক ছিলেন। তিনি এ সমস্ত ব্যাংক যেমন- হংকং ব্যাংক, শাংহাই ব্যাংক, মারকেন্টাইল ব্যাংক এবং ইন্দোচায়না ব্যাংক থেকে শেয়ার সরিয়ে ফেলেন। ব্যাংকে  জমাকৃত অংক খুব দ্রুত ১০ কোটি টাকা থেকে মাত্র ছয় বছরে ১০০ কোটি টাকায় উন্নতী হয়।

তাঁর দেশ প্রেমিক মনোভাব এবং ব্যাংকক ব্যাংকের সেবা গ্রাহকদের আস্থা স্থানীয় ব্যাংকগুলোর প্রতি নিয়ে আসে।

স্থানীয় ব্যাংকগুলির মধ্যে তিনিই প্রথম বৈদেশিক বানিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীগনকে বিস্তারিত পরামর্শ ও সেবামূলক সহযোগীতা প্রদানের পদক্ষেপ নেন। ব্যাংকের কর্মচারীবৃন্দ স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কারবারীদের হয়ে সমস্ত কাগজপত্র পূরন করে দিত আর ঐ সমস্ত ব্যবসায়ী বা কারবারীদের  যা করতে হতো তা হলো শুধুমাত্র তাদের কোম্পানীর সীল ও সাইন দেয়া। বানিজ্য ও আর্থিক সহযোগীতা পাওয়া যায় এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ব্যাংকের অগ্রগতি ও দ্রুত গতিতে বেড়ে চলল এবং এভাবেই এটা থাই ব্যাংকিং এর অগ্রভাগে থেকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পেরেছে।

ব্যাংকের কাজের জন্য জরুরী সকল ধরনের তথ্য তিনি সংগ্রহ করতেন। তিনি ব্যবসার কাজে সহায়ক হতে পারে এমন নানা রকমের দৈনিক প্রতিবেদন নিয়মিত প্রতিদিন সকাল বেলায় পড়তেন এবং অফিসের কর্মচারীদের সাথে আলোচনা করতেন।

তিনি  সবসময় নতুন ধ্যান ধারনার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং কোন সময়ই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করতেন না। এর প্রমান মিলে যখন তিনি ১৯৭৮-৭৯ সালে ব্যাংকে ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং চালু করেন। ব্যবস্থাপনার নতুন নতুন ধারনাগুলোকে তিনি গ্রহন করতেন এবং ব্যাংক কর্মচারীদের তাদের কর্মের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করার জন্য তিনি তাদের কাছে ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির ব্যবস্থা করেন।

তিনি অত্যন্ত সুদক্ষ প্রশাসক ছিলেন। সিদ্ধান্ত  গ্রহনে তার বিচক্ষণতা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁর একই সাথে অনেকগুলো ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ছিল কেননা তিনি বিভিন্ন বিষয় আলাদা করে বিশ্লেষন করে সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন।

তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য গুন ছিল যখনই তাঁর চলার পথে কোন বাঁধা বা সমস্যা আসতো তখনই তিনি সেটাকে সুযোগ সুবিধায় পরিনত করতে পারতেন। ১৯৫৮ সালে একটি রাজনৈতিক কারনে তাঁকে থাইল্যান্ড ছেড়ে হংকং চলে যেতে হয়। সেখানে তিনি চুপচাপ বসে থাকেননি। এই নির্বাসনকালে তিনি তাঁর ব্যাংকের চারটি নতুন বৈদেশিক শাখা স্থাপন করেন, এরই মধ্যে তিনটি ছিল ভিয়েতনামে এবং একটি তাইপে-তে।

মিঃ চিনের সাফল্যের পেছনে অনেক উপাদানের মধ্যে একটি হল যে, তিনি তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে যে সব ব্যবসায়িক মহলের সাথে যোগযোগ স্থাপন করেছেন, সে সবগুলোকেই রক্ষা করে গেছেন এবং সময়ের সাথে আরও দৃঢ় করেছেন।

ব্যবসায়িক মহলের সাথে এবং উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে মিঃ চিনের সখ্যতা তাঁকে ব্যবসায়ে লক্ষ্য অর্জনে  সাহায্য করত। তাঁরা এক সাথে জীবনে এগিয়ে গিয়েছেন এবং তারা পরস্পরকে ভাল বুঝতেন।

তিনি নিজে পরিশ্রম করতেন এবং একজন ভাল ব্যাবস্থাপক হওয়ার কারনে অন্যদেরকেও পরিশ্রম করাতে পারতেন। প্রথম দিকে তাঁর কর্মকর্তাদের জন্য অনেক মাস কোন ছুটি ছিল না। তারা শনিবার, রবিরার, বাড়তি সময় পরিশ্রম করে, এমন কি ছুটির দিনগুলোতে কাজ করে গ্রাহকদের চাহিদা মিটিয়ে দিত।

যে সমস্ত লোক নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেরই ব্যক্তিগত শত্রু থাকতে দেখা যায়। কিন্তু মিঃ চিনের কোন শত্রু ছিল না। প্রতিযোগী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সব সময়ই সৎভাব বজায় রাখতেন। প্রয়োজনবোধে কোন সুবিধা বা ব্যবসা অন্যকে ছেড়ে দিতেন যাতে প্রতিযোগীদের মনে শত্রুভাব না থাকে।

তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, কর্ম জীবনে শত্রু থাকলে তাকে বন্ধু ভেবে জয় করা উচিত শত্রুভেবে পরাজিত করে নয়। আর এভাবেই মিঃ চিন জীবন, ব্যবসা এবং মানুষের কাছে গিয়েছেন।

মিঃ চিন একজন কীর্তিমান পুরুষ ছিলেন। তিনি যা কিছু করতে চেয়েছেন তাই সফলতার সাথে করেছেন।

আপনার মতামত জানান