‘মামলাবাণিজ্যে’র লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা!

প্রকাশিত


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হতাহতের ঘটনায় ঢালাওভাবে মামলা করে বাছবিচার ছাড়াই আসামি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে কয়েকটি চক্র মেতেছে মামলাবাণিজ্যে। আর তাদের লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কর্ণধাররা। মামলায় আসামি না করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।


দাবি করা টাকা না দিলেই দেওয়া হচ্ছে একের পর এক মামলা।

শুধু ব্যবসায়ীই নন, বাদ যাচ্ছেন না শিক্ষক, সাংবাদিক ও তারকারাও। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও পূর্বশত্রুতার জেরে মামলার আসামি করারও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদী চেনেন না আসামিকে আর আসামি চেনেন না বাদীকে।


এমনকি ঢাকার ঘটনার মামলায় আসামি করা হয়েছে ঢাকার বাইরের জেলার শত শত মানুষকে।

এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ মামলা প্রকৃত ভুক্তভোগীদের সঠিক বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের বাইরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেডআই খান পান্না।


তিনি বলেন, ‘যখন ঢাকার ঘটনায় রাজশাহী, রংপুর আর লালমনিরহাট থেকে ১০০-১৫০ মানুষ আসামি হবে, তখন খুব সহজেই অনুমান করা যায় এগুলো বানোয়াট মামলা। এগুলো শুধু হেনস্তার জন্য করা হয়েছে।

রংপুর থেকে ১০০ জন মানুষ ঢাকায় এসে একজনকে খুন করবে না। যেখানে লোক মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। এগুলো স্ক্রিপ্টেড (সাজানো)। কেউ একজন লিখে দিচ্ছে, সেগুলো থানায় থানায় চলছে। ব্যবসায়ীরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এক নম্বর আসামি শেখ হাসিনা, দুই নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এরপর অমুক এলাকার ২০০ লোক! এগুলো কিছু হলো! এ ধরনের মামলাগুলো করাই হয় প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। ’
যাদের হেনস্তার উদ্দেশ্যে এসব মামলায় নাম দেওয়া হয়, তাদের উদ্দেশ্য করে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, ‘আমাকে এভাবে হেনস্তা করার জন্য কেউ মামলায় আসামি করলে আমি তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানহানি মামলা করতাম। ’

সম্প্রতি সুপরিচিত একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কর্ণধারসহ প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে তিন কোটি টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় হতাহতের ঘটনায় হওয়া মামলায় আসামি করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।

আইনজীবী পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি বলেন, তাদের সঙ্গে আরো অনেকেই আছেন, যারা খুবই প্রভাবশালী। পুরো অর্থ না দিলে মামলা হয়ে যাবে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির কর্ণধারের বিরুদ্ধে। হুমকিদাতা ওই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাকে একটি বাসায় নিয়ে দেন-দরবার চালিয়ে টাকা আদায়ে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা না পেয়ে আদালতের মাধ্যমে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা ঠুকে দেয়।

এখানেই থেমে থাকেনি ওই চক্র। কিছুদিন পর আবারও টাকার জন্য চাপ দিয়ে জানায়, চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে নতুন করে আরো মামলা দেওয়া হবে। সেই টাকা না পেয়ে পল্টন থানায় আরো একটি হত্যা মামলা করা হয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির কর্ণধারের বিরুদ্ধে। অথচ এই ব্যবসায়ী কখনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

এ ঘটনার মতোই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আর মামলাকে হাতিয়ার বানিয়ে কয়েকটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা। এ নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। অনেকে বাসাবাড়িতে থাকতে পারছেন না। যারা গত সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেননি, তারাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারাও ঢালাও মামলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গণমাধ্যমকে তারা বলেন, প্রতারক চক্র মামলা-বাণিজ্য করছে, তা সত্য। নিরপরাধ ব্যবসায়ী ও লোকজনদের মামলা দিয়ে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ এসেছে। এসব বিষয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, ‘প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমরা সতর্ক আছি। একটি চক্র অর্থ না পেয়ে মামলা দিচ্ছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। তাদের বিষয়টি আমরা নজরদারি করছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজনকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্ত শুরু হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘কোনো মামলার এজাহারে নাম থাকলেই যে গ্রেপ্তার করতে হবে, আইনে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। তদন্ত শেষে তারপর গ্রেপ্তারের বিষয়টি আসে। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে না, তাদের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম সহিংসতার ঘটনায় এত কম সময়ে সর্বাধিকসংখ্যক মামলা হয়েছে। ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময় ২০০-এর বেশি মামলা হয়। যেসব মামলায় আসামি করা হয়েছিল এক লাখের বেশি। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় হাজারের মতো শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ এবং কয়েকটি দলের নেতাকর্মী নিহত হন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে মামলা হচ্ছে বিভিন্ন থানায়। ৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে ৫০০-এর বেশি হত্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগ এজাহার একই ধরনের। প্রথম ১০ থেকে ২০ জন আসামি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে অনেক মামলার বাদী চেনেন না আসামিকে। আসামিও বাদীর নাম শোনেননি কখনো। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী-অঙ্গসংগঠনের থানা, জেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হচ্ছে। কিছু কিছু মামলায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষও আসামি হচ্ছেন, যা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য এসেছে, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তৎপর হয়ে উঠেছে কয়েকটি প্রতারক চক্র। তারা মিথ্যা অভিযোগে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। বিশেষ করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের টার্গেট করছে। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও ঘায়েলের চেষ্টা করছে।

এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে বলেছে, মামলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রতারণায় সম্পৃক্তদের দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনতে হবে। এই নির্দেশনা পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও কাজ শুরু করেছেন।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় মামলা নিয়ে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠার গুরুতর অভিযোগ এসেছে। আইনজীবী পরিচয় দিয়ে কেউ কেউ প্রতারক চক্রদের সহযোগিতা করছে। তা ছাড়া প্রতারকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও সুসম্পর্ক আছে। সুযোগ পেয়ে তারা মিলেমিশে অপকর্ম চালাচ্ছে। যারা এসব অপকর্ম করছে, তাদের নজরদারির পাশাপাশি আইনের আওতায় আনতে পুলিশের সব কটি ইউনিটপ্রধান ও জেলা পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ’

একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, মামলার আসামিদের ধরতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। এসব অভিযানে নিরপরাধ অনেকে গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তা ছাড়া অভিযানের নামে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে তালিকা সংগ্রহ করার তথ্যও মিলেছে। গত ২৫ আগস্ট ঢাকার দোহার থানায় ১৭৪ জনের নামে একটি হত্যা মামলা হয়। এজাহারে থাকা আসামিদের ঠিকানার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর একজন ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে।

তিনি দাবি করেছেন, গত ১০ বছরেও গ্রামের বাড়িতে যাননি। নাম প্রকাশ না করে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা সারাজীবন ব্যবসা করি। সে হিসেবেই সরকারে যেই থাকে তাদের সঙ্গেই আমাদের মিলেমিশে চলতে হয়। আমরা কোনো রাজনীতি করি না। আমার নামে হত্যা মামলা করা হয়েছে, অথচ ১০ বছরে আমি এলাকাই যাইনি।’

মামলাটির বাদী শাজাহান মাঝি দাবি করেছেন, আসামিদের অধিকাংশকেই চেনেন না তিনি। তাহলে মামলাটি করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনৈতিক মামলা, তাই সবাইকে চেনেন না, নেতারা যাদের নাম দিয়েছেন, তাদেরই আসামি করা হয়েছে।

একইভাবে ঢাকার আরো তিনজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর অভিযোগ, তারা কখনো রাজনীতিই করেননি। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যাননি। অথচ ঢাকার ধানমন্ডি, পল্টন, ভাটারা, গুলশান, উত্তরাসহ কয়েকটি থানায় মামলা করা হয়েছে তাদের নামে। আবার মামলা করার আগে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। এখন মামলা থেকে নাম বাদ দিতে ফের অর্থ দাবি করা হচ্ছে। যারা মামলা-বাণিজ্য করছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনাসহ সুষ্ঠু তদন্ত করে মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার দাবি জানান এই তিন ব্যবসায়ী।

এ প্রসঙ্গে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন বা তাদের সহযোগী নন, এমন কাউকে হয়রানি না করতে আমাদের কাছে নির্দেশনা আছে। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত করছি। নিরপরাধ ব্যবসায়ী ও নিরীহ লোকজন হয়রানির শিকার হবেন না। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে না, তাদের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে।’

ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে গত ১৬ জুলাই থেকে রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে উত্তরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট পর্যন্ত ওই এলাকা যেন ছিল রণক্ষেত্র। এই তিন সপ্তাহ জুড়ে আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশের গুলিতে প্রতিদিনই পড়েছে একাধিক লাশ।

উত্তরার হত্যাকাণ্ড নিয়ে সঠিক হিসাব না পাওয়া গেলেও ২০০-এর বেশি প্রাণহানির তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে আসে। সরকার পতনের পর সারা দেশের মতো উত্তরায়ও হত্যা মামলা হয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ স্থানীয় নেতাদের নামে। উত্তরা পশ্চিম ও পূর্ব থানায় এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে।

এসব মামলার কয়েকটির আসামির তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি কিছু অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীকেও আসামি করা হয়েছে। ঢালাওভাবে প্রতিটি মামলায় ১৫০ থেকে ৩০০-এর বেশি আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় আছেন উত্তরার বিভিন্ন সেক্টর কল্যাণ সমিতির নেতা, শিক্ষক ও ব্যবসায়ীও।

উত্তরা পূর্ব থানার একটি হত্যা মামলার এক আসামি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি শুনেছি, ব্যবসায়িক এক প্রতিপক্ষ আমাকে মাঠছাড়া করতে আসামি করেছে। বাড্ডা থানার আরেকটি হত্যা মামলায়ও আমাকে আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।’

দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকায় মন্তাজ নামে এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যদিও তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে তার এক ছেলে ও এক ভাগনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। সেই সুযোগ নিয়ে তাকে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মন্তাজ।

প্রিয়াংকা সিটির মালিক সজল চৌধুরী ও তার ছেলেকে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। গত পাঁচ বছর স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) হাবিব হাসানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলতে পারেননি সজল চৌধুরী। এজন্য তার কয়েক বিঘা জমি দখলে নিয়ে নেন হাবিব হাসান। তারপরও ছেলেসহ মামলার আসামি হয়েছেন।

সরকার পতনের আগের দিন রাজধানীর জিগাতলা এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলায় গুলিবিদ্ধ হন আবদুল্লাহ সিদ্দিকী নামে এক শিক্ষার্থী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আবদুল্লাহকে হত্যা করে লাশ গুমচেষ্টার অভিযোগে ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের নির্দেশে ধানমন্ডি থানায় মামলা হয়। যার বাদী হয়েছেন ফাইয়াজ আহমেদ রাতুল নামে একজন। এজাহারে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সহ-সমন্বয়ক হিসেবে।

তিনি মামলার অভিযোগে বলেছেন, ‘ঘটনার দিন আবদুল্লাহ সিদ্দিকীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে মামলার পাঁচ আসামি মরদেহ ময়নাতদন্ত না করে নিয়ে যেতে এবং দাফন করতে চাপ প্রয়োগ করে। তাদের ভয়ে মরদেহ ময়নাতদন্ত না করে দাফন করা হয়।’

মামলাটির আসামিদের মধ্যে পাঁচজনের দুজন দেশের দুটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কর্ণধার। এই মামলায় শেখ হাসিনাকেও আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি আছে ২৫০ জন। যাদের বিরুদ্ধে লাশ গুমের চেষ্টা ও ময়নাতদন্ত না করে দাফনের জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাদের চেনেন কি না মোবাইল ফোনে কল করে এমন প্রশ্ন করতেই আমতা আমতা করতে থাকেন রাতুল। একপর্যায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তারপর ১০ বারের বেশি কল করা হলেও তিনি আর কল রিসিভ করেননি। এরপর ফোন বন্ধ করে রাখেন।

নিজেকে সহ-সমন্বয়ক দাবি করা এই রাতুল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের কাছে। তাদের একজন আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘এই নামে (রাতুল) কেউ নেই। আর আমরা এলাকাভিত্তিক কোনো সমন্বয়ক দিইনি। অনেকেই এলাকায় নিজেদের সমন্বয়ক বা সহ-সমন্বয়ক পরিচয় দেন। সেগুলোর কেন্দ্রীয় কোনো অনুমোদন নেই।’

সিএমএম (পল্টন আমলি) আদালতে হওয়া এক মামলার বাদী নিজেই ভুক্তভোগী। মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী মো. বিল্লাল হোসেন অভিযোগে বলেছেন, ‘গত ৪ আগস্ট তাকে পল্টনের তোপখানা রোডে গুলি করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ৬ আগস্ট আবার তাকে পল্টনের একটি রাস্তায় ফেলে রেখে যাওয়া হয়। ’ এ মামলায় আরো একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের কর্ণধারকে আসামি করা হয়। তবে মামলার বিষয়ে জানতে বাদীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

সরকার পতনের দিন সকালে রাজধানীর উত্তরায় বিক্ষোভ চলাকালে লাবলু মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এক মাস পর নিহতের চাচাতো ভাই দুখু মিয়া ২২০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন উত্তরা পূর্ব থানায়। আসামিদের মধ্যে ২১০ জন রংপুরের বাসিন্দা। নিহত লাভলু ও তার ভাই মামলার বাদী দুখু দুজনের বাড়িই রংপুরে। ঢাকার ঘটনা ও ঢাকার থানায় হওয়া মামলায় রংপুরের ২১০ জন আসামি থাকায় মামলাটির অভিযোগের সত্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে খোদ তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের মধ্যেই।

ঢালাও মামলা নিয়ে উপদেষ্টা ও রাজনীতিকদের মত

ঢালাও মামলা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা এবং বিভিন্ন দলের রাজনীতিকরা। এর মধ্যে গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে নিম্ন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির অভিভাষণ অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘গায়েবি মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি এ অন্তর্বর্তী সরকার সমর্থন করে না। ঢালাওভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিচারকদের দেখতে হবে অযথা নাগরিকরা যেন হয়রানি না হয়।’

গত ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণকালে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সারা দেশে যে মামলাগুলো হয়েছে, তার মধ্যে অনেক মামলাই আসলে আবার গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সে ক্ষেত্রে আহ্বান জানিয়েছি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যাতে পুলিশ প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নেয় এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে।’

গত ২৮ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে। যেকোনো মামলা নথিভুক্ত করার আগে প্রাথমিক তদন্ত করে নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাই।’

আপনার মতামত জানান