মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে নির্মম নির্যাতন
কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের একটি বাড়িতে মনের খেয়ালে ঢুকে পড়ায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বাড়ির মালিক সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা মুখলেছুর রহমান খান শাহানের নির্দেশে এ নির্যাতন চালানো হয়। যুবকটিকে মাঠে ফেলে লাঠি দিয়ে বেদম পিটানো হয়। পাশেই চেয়ারে বসে এই নির্যাতন দেখছিলেন আর নির্যাতনের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন শাহানসহ আরো কয়েকজন। শতাধিক লোকের সামনে এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাঁকে রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনি। মার খেয়ে যুবকটি ‘আমার আম্মা আইতাছে গো’ বলে চিৎকার করলেও কারো মন গলেনি। পরে যুবকটির বাবা ও ভাইয়ের কাছ থেকে জোরপূর্বক মুচলেকা নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঈদের পরের দিন গত বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার পূর্ব দড়িজাহাঙ্গীর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পরে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এ ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ বাড়ির মালিক প্রভাবশালী শাহানকে না ধরলেও বাড়ির কেয়ারটেকার সাজ্জাদ হোসেন হিটলারকে (২৫) আটক করেছে।
নির্যাতিত যুবকের নাম মো. মোশাররফ হোসেন (১৯)। তিনি উপজেলার তাড়াইল-সাচাইল ইউনিয়নের শামুকজানি গ্রামের পশুচিকিৎসক কেন্তু মিয়ার ছেলে। দুই-তিন মাস আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন মোশাররফ। এরপর থেকে তাঁকে কখনো কখনো তালাবদ্ধ করে রাখা হতো। ছেড়ে দিলেও চোখে চোখে রাখা হতো। ঈদ উপলক্ষে গত বুধবার তাঁকে তালাবদ্ধ অবস্থা থেকে ছেড়ে দিয়েছিল পরিবারটি।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সকালে ঘুরতে ঘুরতে যুবক মোশাররফ সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা মুখলেছুর রহমান খান শাহানের প্রাচীরঘেরা বিশাল বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েন। বাড়ির মালিকের নির্দেশে কেয়ারটেকারসহ অন্যরা তাঁকে ধরে বেঁধে ফেলে। এরপর বাড়ির পাশেই একটি খোলা জায়গায় নিয়ে চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। ঘটনাটি দেখছিলেন অন্তত শতাধিক লোক। নির্যাতনের দৃশ্য অনেকে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে। পরে এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, বাড়ির কেয়ারটেকার সাজ্জাদ হোসেন হিটলার বাঁশের লাঠি দিয়ে সজোরে মোশাররফের পায়ের পাতায় পেটাচ্ছিল। আর আলম মিয়া নামে আরেক ব্যক্তি তাকে সহযোগিতা করছে।
নির্যাতনের সময় মোশাররফ ‘আব্বা গো আব্বা গো আমারে মাইরালতাছে গো। আম্মা কই ও আম্মা। আমার আম্মা আইতাছে গো…’ বলে আর্তনাদ করছিলেন। কিন্তু তখন অনেক লোক উপস্থিত থাকলেও কেউ তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি।
খবর পেয়ে এলাকার লোকজন নিয়ে স্বজনরা ছুটে যায় ওই বাড়িতে। তাদের সামনেও চলে আরেক দফা নির্যাতন। পরে দুপুরের দিকে মোশাররফের বাবা কেন্তু মিয়া (৬৫) ও বড় ভাই সাদ্দাম হোসেনের (২৫) কাছ থেকে জোরপূর্বক মুচলেকা নিয়ে যুবকটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকার লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা মুখলেছুর রহমান খান শাহান যুবককে মারধরের কথা স্বীকার করে বলেন, যুবকটি উল্টাপাল্টা কথা বলছিল। তিনি বিষয়টিকে তুচ্ছ ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। ছেলেটিকে পুলিশে না দিয়ে মারধর করালেন কেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাবা ও ভাই মুচলেকা দিয়ে নিয়ে যাওয়ায় পুলিশে দেওয়া হয়নি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোশাররফদের বাড়ি শামুকজানি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল তাঁর মা খোদেজা খাতুন ও দাদি কমলা আক্তার বিলাপ করে কাঁদছেন। শত শত মানুষ দেখতে এসেছে নির্যাতনের শিকার মোশাররফকে। তারা বলছে, ওই কাস্টমস কর্মকর্তা এমনিতেই বদমেজাজি মানুষ। এলাকায় টাকার গরম দেখান। মা খোদেজা খাতুন বলেন, ‘আমার কইলজাডা অহন দরফর করতাছে। আমরা না গ্যালে তো আমার ফুতেরে মাইরাই ফালাইল অইলে। আমি এই শিমারের (পাষাণ হৃদয়) বিচার চাই।’
পেশায় কৃষক মোশাররফের বড় ভাই সাদ্দাম হোসেন বলেন, দুই-তিন মাস আগে মোশাররফের মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। তার চিকিৎসাও চলছে। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইডারে মারছে খালি টেহার গরমে। নাইলে কোনো সুস্থ মানুষ এমনটা করতে পারে না। তিনি তো আমার ভাইয়ের চেয়েও অস্বাভাবিক।’
খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাড়াইলের উপজেলা চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম শাহীন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মোশাররফ হোসেন ও ওসি মো. মুজিবুর রহমান নির্যাতিত মোশাররফের বাড়িতে যান। তাঁরা যুবকের স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
তাড়াইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুজিবুর রহমান বলেন, নির্যাতিত ছেলেটির বড় ভাই সাদ্দাম হোসেন বাদী হয়ে কাস্টমের সাবেক কর্মকর্তাসহ তিনজনকে আসামি করে মামলা করেছেন। এর মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
আপনার মতামত জানান