মাত্র ৬০ জন কথা বলে রেংমিৎচা ভাষায়

প্রকাশিত

রয়োগ, ব্যবহার ও পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাওয়ার পথে পার্বত্য চট্টগ্রামের রেংমিৎচা ভাষা। তুলনামূলক কম জনঘনত্বের পার্বত্য জনপদে একটা সময়ে ছয় থেকে সাত হাজার মানুষ এই ভাষায় কথা বলত। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানের তথ্য, ছয় দশকের ব্যবধানে রেংমিৎচা ভাষাভাষীর সংখ্যাটি নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬০-এ। এ অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ ভাষার তালিকায় নাম ওঠার পথে ‘রেংমিৎচা’র।

পার্বত্য জনপদে ঠিক কবে থেকে রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলা শুরু হয়, সে তথ্য কারো জানা নেই। দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এই ভাষার বিষয়ে কোনো প্রামাণিক দলিলও নেই। তবু আজও কেউ কেউ প্রাণের এ ভাষাকে পরম যত্নে আগলে রেখেছেন। তৈনফা মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) রেংপুং ম্রো তাঁদেরই একজন।

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা সদরের কাছাকাছি এক বাড়িতে গত বুধবার কথা হয় রেংপুং ম্রোর সঙ্গে। বয়স পঁচাত্তরের ঘরে। তবে খাটুনির দেহে বয়সের ছাপ পড়েনি। সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্মের তরুণরা তাদের মায়ের মুখের বুলিকে আগলে রাখবে, হারিয়ে যেতে দেবে না।

রেংপুং ম্রো জানান, ভারত ভাগের আগে মাতামুহুরী নদীর অববাহিকায় তৈন খালের দুই পারের প্রায় ছয়-সাত হাজার মানুষ রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলত। তাঁর ধারণা, এখন সর্বোচ্চ ৬০ জন মানুষ এই ভাষায় কথা বলতে পারেন। তবে তাঁদের কারোরই বয়স সত্তর বছরের নিচে নয়। নতুনরা রেংমিৎচা ভাষা না শিখলে তাদের মৃত্যুর পর কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে এই ভাষা, এমন শঙ্কা তাঁর।

রেংপুং জানান, রেংমিৎচা ভাষা জানা হাতে গোনা মানুষগুলোও সব সময় এ ভাষায় কথা বলার সুযোগ পান না। হাট-বাজার বা পথে-ঘাটে সতীর্থদের সঙ্গে দেখা হলেই শুধু তাঁরা নিজেদের মধ্যে এই ভাষায় কথা বলেন।

রেংমিৎচা স্বতন্ত্র কোনো ভাষা নাকি ম্রো ভাষার একটি উপভাষা, তা নিয়ে বড় কলেবরে কোনো গবেষণা হয়নি। এক যুগ আগে একজন ব্রিটিশ গবেষক আলীকদমের তৈন খাল এলাকা ঘুরে এ ভাষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে বান্দরবান প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি গবেষণার বিষয় তুলে ধরেন। রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে গবেষণা, শুলুক-সন্ধান—যা-ই বলি না কেন, এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র উদ্যোগ। এর বাইরে রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাজ শুরু হয়েছে বা চলছে, এমন তথ্যও কেউ জানাতে পারেননি।

তৈনফা মৌজার প্রধান রেংপুং জানান, তাঁর মৌজায় জুমচাষের জন্য সরকারকে খাজনা দেয় প্রায় ৩০০ পরিবার। এর বাইরে খাজনা রেয়াত পাওয়া আরো শ দুয়েক পরিবার রয়েছে। এসব পরিবারের সব সদস্যই একটা সময়ে রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলত। কিন্তু বর্তমানে তাঁর নিজের পাড়া এবং তৈন খালের উভয় পারের ক্রাংচিপাড়া, পায়া কার্বারিপাড়া ও টিংকুপাড়ায় বসবাসকারীরাই শুধু রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলেন। এঁদের মধ্যে রেংপুং ম্রো হেডম্যান নিজে, মাংপুং ম্রো, তিংওয়াই কার্বারি ও লাউলী ম্রো রেংমিৎচা ভাষাটি ভালো জানেন। রেংপুং হেডম্যানের বড় মেয়ে কাইতুন ম্রো ভাষা অল্পবিস্তর বলতে পারেন।

অন্যদিকে রেংপুং হেডম্যানের পৌত্র লাংচিং ম্রো বান্দরবান সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত। তবে তিনি এ ভাষাটি এখনো শিখছেন। তাঁর মতো নবীনদের মাধ্যমে রেংমিৎচা ভাষা আগামী দিনগুলোতে বিকশিত হবে—এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন বয়োবৃদ্ধ রেংপুং ম্রো।

রেংপুং ম্রো জানান, ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌজাব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে তাংলিং ম্রো প্রথম হেডম্যান নিযুক্ত হন। তিনি শতভাগ রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন। সম্পর্কে তিনি রেংপুং ম্রোর নানা। বাবা উকলিং হেডম্যান ছিলেন না। তিনি একটি পাড়ার কার্বারি হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনায় অবদান রেখে যাচ্ছেন। তিনিও রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন। তাংলিং হেডম্যানের মৃত্যুর পর হেডম্যান হন রেংপুং ম্রোর চাচা ইয়াং ইয়ুন ম্রো। তিনিও রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন।

রেংপুং জানান, রেংমিৎচা ভাষাভাষী সবাই জাতিগতভাবে ম্রো জনগোষ্ঠীভুক্ত। ম্রোদের মধ্যে কেউ কেউ নব প্রবর্তিত ক্রামা কিংবা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও রেংমিৎচা ভাষাভাষীদের সবাই বৌদ্ধ ধর্মরীতি অনুসরণ করেন। ম্রো বংশোদ্ভূত হলেও রেংমিৎচা ভাষার সঙ্গে ম্রো ভাষার (কথ্য) খুব একটা মিল নেই। তবে ‘খুমি’ ও ‘বম’ জাতিসত্তার কথ্য ভাষার সঙ্গে কিছু কিছু মিল রয়েছে রেংমিৎচা ভাষার।

সুত্র: কালের কন্ঠ

আপনার মতামত জানান