মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্বের ভাষণ
নবী-রাসুলগণ সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের বাণীর দাওয়াত দিয়েছেন অহিংস পন্থায়। প্রিয় নবীজিও এর ব্যতিক্রম নন। তারপরও অসুরশক্তি প্রীতির কথায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়, শান্তির বাণীতে অশান্তি সৃষ্টি করে। তিন বছর ধরে আল্লাহর হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ‘শিআবু আবিতালেব’ নামক কারাগারে বন্দী করে রাখে। দাওয়াতি কাজে তায়েফ গমন করলে নির্মম নির্যাতনে জর্জরিত করে।
মক্কায় ফিরে আসতে চাইলে নগরে প্রবেশে বাধা দেয়। ‘দারুন নাদওয়া’য় বুড়ো শয়তানের পরামর্শে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। সব চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে রবিউল আউয়াল মাসে আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) প্রিয় জন্মভূমি মক্কা শরিফ ছেড়ে হিজরত করে মদিনা শরিফে চলে যান। তখন তাঁর বয়স তিপ্পান্ন বছর।
দ্বিতীয় হিজরি সন তথা হিজরতের দ্বিতীয় বছর রমজান মাসের ১৭ তারিখ বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ বছরই প্রথম উভয় ঈদের প্রবর্তন ও সূচনা হয়। বদরের বিজয়ের ১৩ দিন পর পয়লা শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করা হয়। এই বছরই মদিনার সুদখোর মহাজন ইহুদি বনু কাইনুকা সম্প্রদায়কে পরাস্ত করার পর ১০ জিলহজ প্রথম ঈদুল আজহা (কোরবানির ঈদ) পালন করা হয়।
ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবীজি (সা.) ওমরাহর উদ্দেশে মক্কা যাত্রা করলেন। কুরাইশরা বাধা দিলে হজরত (সা.) হুদায়বিয়া নামক জায়গায় অবস্থান করেন। এখানেই হজরত উসমান (রা.)-এর মধ্যস্থতায় মক্কার কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। এটিই বিশ্বের প্রথম লিখিত সন্ধিচুক্তি, যা ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে বিখ্যাত।
অষ্টম হিজরি; বিশ্বমানবতার কেন্দ্রভূমি মক্কা পঙ্কিলতামুক্ত হওয়া এখন সময়ের দাবি। বিশ্বনবী নীরবে সে আয়োজন করলেন। এ জন্য পবিত্র মক্কা জয় করতে হবে। তবে ‘তিনি ধ্বংসাত্মক বিজয় চান না, তিনি কুরাইশদের রক্ষা করতে চান। তিনি চান প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে। অষ্টম হিজরির রমজান মাসে মক্কা বিজয় হয় এবং নবীজি (সা.) ওমরাহ সম্পাদন করেন। দশম হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায় সোয়া লাখ সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে হজ সম্পাদন করেন। এই হজই নবীজি (সা.)-এর জীবনে একমাত্র হজ; এটিই প্রথম হজ ও শেষ হজ। এর ৮৩ দিন পর ১২ রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন; এই কারণে এই হজ ইতিহাসে বিদায় হজ নামে প্রসিদ্ধ। (বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা)।
বিদায় হজের ভাষণ
বিদায় হজে প্রিয় নবীজি (সা.) উপস্থিত সোয়া লাখ সাহাবির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত। এটি ছিল তাঁর জীবনের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক ভাষণ, যা তিনি দশম হিজরি সনের নবম জিলহজ আরাফার দিনে মসজিদে নামিরাতে ও জাবালে রহমতের ওপরে এবং পরদিন দশম জিলহজ ঈদ ও কোরবানির দিন মিনাতে প্রদান করেছিলেন। (সিরাতুন নবী (সা.), ইবনে হিশাম (র.), খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৭৩-২৭৭)।
নবীজি (সা.) তাঁর ভাষণে বলেন: হে লোক সকল! আল্লাহু তাআলা বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো, নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্মানিত যে সর্বাধিক পরহেজগার।’ (সুরা ৪৯, হুজুরাত, আয়াত ১৩)। কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। সব মানুষ আদম (আ.)-এর সন্তান আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট। এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসীদের) প্রতি খেয়াল রাখবে, তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকেও তা পরাবে। সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়েছে। তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, সন্তুষ্ট চিত্তে সম্পদের জাকাত প্রদান করবে, স্বীয় প্রভুর ঘরে এসে হজ পালন করবে; তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
মানবতার ঐতিহাসিক দলিল বিদায় হজের ভাষণ
হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব না। অচিরেই তোমরা তোমাদের মহান প্রভুর সাক্ষাতে উপনীত হবে। তখন তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তোমাদের কারও কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের নিকট অবশ্যই পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই সকল প্রকার সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ ফয়সালা দিয়েছেন যে আর কোনো সুদ নয়। আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ রহিত করা হলো। তোমরা কোনো জুলুম করবে না, বরং তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। জাহিলি যুগের যত রক্তের দাবি, তা সব রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি রবিয়া ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির (র.), খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৯৮ ও ৩২০-৩৪২, ই. ফা. বা.)।
নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক প্রাপকের জন্য তার অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের জন্মদাতা ছাড়া অন্যের সঙ্গে নিজের বংশসূত্র স্থাপন করে এবং যে নিজ মনিব ছাড়া অন্যকে মনিব বলে স্বীকার করে, তার ওপর আল্লাহর লানত। সব ঋণ পরিশোধের যোগ্য ও অধিকার, ধারকৃত বস্তু ফেরতযোগ্য, উপঢৌকনেরও বিনিময় প্রদান করা উচিত, জামিনদার জরিমানা আদায় করতে বাধ্য থাকবে। কারও জন্য তার অপর ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়; যতক্ষণ না সে নিজে সন্তুষ্ট চিত্তে প্রদান না করে। কোনো মহিলার জন্য তার স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীর অর্থসম্পদ থেকে কাউকে কিছু দেওয়া বৈধ নয়। তোমরা কখনো একে অন্যের ওপর জুলুম কোরো না। নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে এবং তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার আছে।
অতএব হে মানবজাতি! তোমরা আমার কথা অনুধাবন করো। আমি তো পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের মাঝে এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (স.)-এর সুন্নাহ। আমি তোমাদের মাঝে জিনিস রেখে গেলাম, আল্লাহর কিতাব এবং আমার (নবী স. এর) ইতরাত (আহলে বাইত)।
বিদায় হজযাত্রায় মহানবী (সা.)–র রাগের পেছনে
প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই এবং মুসলিমগণ ভ্রাতৃপ্রতিম। সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে সন্তুষ্ট চিত্তে তাকে তা প্রদান করে। অতএব, তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না। সকলে শোনো! এখানে উপস্থিতগণ যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের নিকট পৌঁছে দেয়। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে।
অতঃপর নাজিল হয়, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম; এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলাম দিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলাম।’ (আল–কোরআন, পারা ৬, সুরা ৫, মায়িদাহ, আয়াত ৩)।
আপনার মতামত জানান