ভেষজ উদ্ভিদ মটকিলা ঔষধিগুণ

গ্রামে আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে গেছেন, টুথব্রাশ বা টুথপেস্ট নিয়ে যাননি। সকালে উঠে বাড়ির পেছন থেকে মটকিলার ডাল ভেঙে মুখে একটু চিবিয়ে থেঁতলে নিয়ে দাঁত ব্রাশ করে ফেললেন। অনেকের এই অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছোটবেলায় বাড়ির পেছনে, বনের ধারে মটকিলা গাছে পাকা ফল খুঁজে বেড়িয়েছি অন্য বাচ্চাদের মতো আমিও। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দার কলেজ রোড এলাকায় রাংসা নদীর ধারে মটকিলা গাছের দেখা পেলাম।
মটকিলা কাষ্ঠল, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এটি উচ্চতায় এক থেকে পাঁচ মিটার হয়। এর অন্যান্য বাংলা নাম আঁশশেওড়া, কওয়াটুটি, মটমটি ইত্যাদি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Glycosmis Pentaphylla, এটি Rutaceae পরিবারের উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ ইংরেজিতে Orange berry, Gin berry, Toothbrush plant, Motar tree ইত্যাদি নামে পরিচিত। এই উদ্ভিদ মারমাদের কাছে ‘তাতিয়াং’, চাকমাদের কাছে ‘হতিজ্ঞিরা’, গারোদের কাছে ‘মোয়াতন’ নামে পরিচিত।
দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপিন্স, দক্ষিণ চীন, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও এবং অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায় এই উদ্ভিদ।
মটকিলার কিছু কিছু গাছ ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। কাণ্ড বেশ শক্ত এবং রং ধূসর। কাণ্ডের দেড় থেকে ২ ফুট পর্যন্ত কোনো ডালপালা হয় না বললেই চলে। কাণ্ডের বেড় দেড় থেকে আড়াই ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। পাতার রং সবুজ। পাতা একপক্ষল, উপবৃত্তাকার, দৈঘ্য ৩-৪ ইঞ্চি। মাঝ বরাবর এর প্রস্থ ২-২.৫ ইঞ্চি। পাতা পাতলা, মসৃণ। মটকিলার ফুল খুব ছোট। ফুলের রং সবুজাভ সাদা। ফুলের ব্যাস ৫-৭ মিলিমিটার। প্রতি ফুলে পাঁচটি করে পাঁপড়ি থাকে। এর ফুল হালকা মিষ্টি গন্ধযুক্ত। পাতা দেখতে লেবু পাতার মতো।
আসলে লেবু, কমলা, জাম্বুরা আর মটকিলা একই গোত্রের, তাই এই মিল। ফল সবুজ রঙের, মটর দানার চেয়ে সামান্য বড়। একটি গুচ্ছে ২০-৫০টি পর্যন্ত ফল থাকে। কাঁচা ফলের রং সবুজ। পাকা ফলের রং গাঢ় গোলাপি, গোলাকার। ফল রসাল, বেশ মিষ্টি। তবে ফলে সামান্য তেতোভাব আছে। পাখি ও শিশুদের প্রিয় এই ফল। মটকিলার ফলের ভেতর দ্বিবীজপত্রী গোলাকার বীজ থাকে। মটকিলার চারা জন্মায় বীজ থেকে।
মটকিলা বেশ কয়েক বছর বাঁচে। প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত বাঁচে। পানি পেলে সারা বছর জন্মায়। বাংলাদেশের সর্বত্র এদের দেখা মেলে। এরা যেকোনো পরিবেশে সহজেই অভিযোজিত হতে পারে। রাস্তার দুই ধারে, জমির আইলে, বাড়ির পেছনে, পুরোনো দালানের ইটের খাঁজে, পুকুরপাড়ে, নদীর ধারে, ঘন ঝোপের আড়ালে প্রায় সব জায়গাতেই জন্মাতে ও বেড়ে উঠতে পারে এরা।
লিভারের সমস্যা, কাশি, জন্ডিস, বাত, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় এ উদ্ভিদের ব্যবহার দেখা যায়। গ্রামের মানুষ এ গাছের ডাল দাঁত মাজার কাজে ব্যবহার করে। মটকিলার পাতা আদার সঙ্গে মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়, যা চর্মরোগের উপশমে ব্যবহৃত হয়। গাছের মূল সেদ্ধ করে তৈরি করা হয় এক ধরনের ক্বাথ, যা মুখমণ্ডলের প্রদাহের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ।
আপনার মতামত জানান