বৃদ্ধাশ্রমে থাকে জন্মদাতা, মা-বাবা নয়

প্রকাশিত

কখনো কাঁধে, কোলে আবার মাথায় নিয়ে খেলা করে। ছেলের আবদার ঘোড়ার ওঠার, সাথে সাথে বাবা ঘোড়া সন্তান ঘোড়া সওয়ার। মা রান্না ঘরে নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত। নাস্তা খেয়েই বাড়ির কর্তা যাবেন কাজে। সব কাজের আগে সকাল বেলা বৃদ্ধ শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে গরম পানিতে হাতমুখ ধুইয়ে রোদে দু’টি পিড়ির মধ্যে বসিয়ে যান। সামনে একটা ওগলা (বিছানা), ওগলার উপর ময়লা চটানো দু’টি কাঁথা বালিশে মা বাবার প্রতি সন্তানের অগাধ ভালবাসা। বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে গেলে যেন ওগলার শুয়ে আরাম করতে পারেন, তার জন্য।

শ্বশুড় দবির মিয়া বয়স ৯০ ছুই ছুই। শ্বাশুড়ি আইবান নেছার পঁচাত্তুর কি আশি। একেবারে দূর্বল না হলেও শক্ত সামর্থ্য নয়। তবু মাঝে মাঝে শ্বাশুড়ি বউয়ের রান্না কাজে হাত লাগাতে চান। ছেলের নিষেধ। কোন কাজে হাত দেয়া যাবে না। দবির মিয়ার সংসারে তিন ছেলে, দুই মেয়ে। সন্তানদের সবাই বিবাহিত।

দবির মিয়ার প্রচুর জায়গা জমি ছিলো। কিন্তু একটি প্রভাবশালী প্রতারক চক্র জাল দলিল করে সব হাতিয়ে নিয়েছে। শক্তি, টাকা এবং প্রভাবের কাছে পরাজিত দবির বাকি সহায় সম্পদ বিক্রি করে জীবন বাঁচাতেই বৃদ্ধাশ্রমের একটু দূরে চার শতাংশ জমি কিনে বসবাস করছে। ছেলেরা সবাই দিনমজুর। কেউ অন্যের ক্ষেতে কামলা, কেউ রিক্সা চালিয়ে জীবন যাপন করে। প্রতিদিন কাজে বের হওয়ার আগে মা বাবাকে সাথে নিয়ে নাস্তা খাওয়ার পর মা বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই তারা কাজে বের হয়। মাঝে মাঝে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে দেখা যায়। বাপ চাচারা যখন দাদা-দাদীকে সালাম করে বের তখন তাদের সন্তানেরাও সালাম করে। সমস্যা একটাই কাজে যাওয়ার সময় সন্তানেরা বাবার পিছু ভো দৌড়। মা তাদের পিছন পিছন ছুটছে। আবার তাদের কোলে কাখে তুলে আদর করে বাবা বাড়িতে রেখে অন্যদিক দিয়ে পালিয়ে কাজে যান।

এ দৃশ্য দেখার জন্যই সকাল সকাল উঠে নামাজ শেষে জানালাার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাবা মা ও সন্তানদের এমন মধুর সম্পর্ক দেখে চোখ গড়িয়ে পানি বুকের উপর দিয়ে নেমে যায়। এত আর্থিক অনটনের মাঝেও বাবা মাকে কিভাবে আগলে রাখে তার সন্তানেরা দেখে দবিরের প্রতি তাদের হিংসা হয়। শেষ বয়সে পৃথিবীর সবচে বড় শান্তি ছেলে সন্তান নাতিপুতির সাথে সময় কাটানো। এটা হাসান সাহেবের থেকে কেউ ভালো অনুভব করতে পারবেন না। শুধু হাসান সাহেব নয় একই রুমে থাকা রুহুল ও শাহীন সাহেবও বুঝেন। তারা তিনজনেই সরকারী বড় আমলা ছিলেন। বৈধ অবৈধ পথে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন।
তাদের ছেলে মেয়েরা প্রত্যেকে অনেক শিক্ষিত। অস্টেলিয়া, কানাডা, চীন যাপান আবার অনেকে দেশে বড় পোষ্টে সরকারি বেসরকারি চাকুরি করছেন। সন্তানেরা অনেক বড় মাপের মানুষ হয়েছে কিন্তু দায়িত্বশীল সন্তান হতে পারেনি। আগে আফসোস থাকলেও দবির মিয়াকে দেখার পর তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে তারা তাদের সন্তানদের জন্মদাতা ছিলেন, মা-বাবা হতে পারেনি। অর্থ, সম্পদ আর আভিজাত্যের মাঝে সন্তানদের বড় করলেও কখনো মা বাবার আদর ভালবাসা সন্তানদের দিতে পারেনি।

হাসান সাহেব ও তার স্ত্রী দুজনেই সরকারি বড় কর্মকর্তা ছিলেন। সন্তান জন্মের চারমাসের মাথায় সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব পায় বাড়ির কাজের বুয়া। সকালে বের হলে স্বামী স্ত্রী সন্ধ্যায় কিংবা রাতে বাড়ি ফিরত। রাতটুকু শেষ হলেই আবার কাজের বুয়া। এভাবেই কোন রকমে প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে ভালো কোন স্কুলের আবাসিক হোস্টেলে। এবার সপ্তাহে, পনের দিন কিংবা মাসে একবার মা বাবা সন্তানের দেখা। এরপর কখনো সন্তানদের একসাথে ১৫দিন সময় দিতে পেরেছেন কিনা মনে করতে পারেন। মা বাবার আদর, স্নেহ ভালবাসা কি তাদের সন্তানেরা জানতে পারেনি। সমস্ত আবদার, লালন পালন, মান অভিমান সব ছিলো কাজের বুয়ার উপর। মা বাবা যেমন তাদের সময় দেয়নি তাদেরও মা বাবার প্রতি মায়া পড়েনি।

ছোট বেলার মা বাবা তাদের কাজের বুয়া ও হোস্টেলের দাত্রীদের দিয়ে সব কিছু মিটিয়েছেন। আজ সন্তানেরাও বৃদ্ধ বয়সে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন। চাকুরির জন্য তারা যেমন সন্দানদের সময় দিতে পারেনি এখন চাকুরিজীবি সন্তানেরা মা বাবাকে সময় দিতে পারছেন না।

হাসান সাহেব ও তার স্ত্রীকে যখন সন্তানেরা বৃদ্ধাশ্রমের দিতে আসেন, তখন তারা অনেক কেঁদেছিলেন তাদের যেন এখানে না নিয়ে আসেন। সন্তানেরা বলেছিলো তোমাদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই বাবা। দেখছোই তো আমি তোমাদের বউ মা চাকুরি করছি। এ সময় তোমাদের বাড়িতে একা রাখা কোনভাবেই নিরাপদ না। হঠাৎ অসুস্থ হলে তোমাদের দেখবে কে? বৃদ্ধাশ্রমে কেয়ার টেকার আছে তারা সব সময় খোঁজ খবর রাখবে। হাসান সাহেব ও তার স্ত্রী তাদের সন্তানদের একটা কথার কোন জবাব দিতে পারেনি। মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা মা বল তো মায়ের আদর কেমন আমরা কি কখনো বুঝতে পেরেছি। এমন একটা দিন কি বলতে পারো, পায়খানা করার পর তোমরা কেউ তা পরিস্কার করে আমাদের হুচু দিয়েছ। বাবার কোল কেমন, সন্তানের জন্য বাবার কাঁধ কতটুকু চওড়া হয় আমরা কি জানতে পেরেছি? তোমরা শুধু আমাদের জন্মই দিলে একটা দিনের জন্যও মা-বাবা হলে না।

আপনার মতামত জানান