ফুটবলতারকা কৃষ্ণা রানী সরকারের উঠে আসার গল্প
অদম্য ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ় অধ্যবসায় এবং সুযোগ-পরিচর্যা থাকলে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না। তার বিকাশ ঘটবেই, সে জ্বলে উঠবেই। সময়ের আলোচিত ফুটবলতারকা কৃষ্ণা রানী সরকারের উঠে আসার পথ মসৃণ নয়। তিনি এক দিনে তারকা বনে যাননি।
তাকে এ পর্যন্ত আসতে পোহাতে হয়েছে অনেক কাটখড়। তবুও সাধনা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার নগদা শিমলা ইউনিয়নের উত্তর পাথালিয়া একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। জেলা ও উপজেলা শহর থেকে বেশ দূরের এ গ্রামেই অতি সাধারণ পরিবারে জন্মেছেন সাফ টুর্নামেন্ট বিজয়ের কারিগর কৃষ্ণা। এবার বাড়িতে আসার পর তার অনুভূতি সত্যিই অন্য রকম, তিনি আপ্লুত। কৃষ্ণা ও তার পরিবারের সঙ্গে কিছু কথা হয় প্রতিবেদকের।
কৃষ্ণার ফুটবলের পথ চলায় প্রেরণার একজন তার কাকা নিতাই সরকার। তিনি বলেন সেই গল্প, ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ ছিল কৃষ্ণার। গ্রামের ধানক্ষেতে ও স্কুলের মাঠে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলত। এটা নিয়ে প্রায়ই আমাদেরকে সমালোচনা শুনতে হতো। আমিই ওকে সর্বপ্রথম একটি তিন নম্বর ফুটবল কিনে দিই। কৃষ্ণা অনেক সময় বাতাবিলেবু ও খড় দিয়ে বল বানিয়েও পোলাপানের সঙ্গে বাড়ির উঠানেই খেলত। ওর বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না। তাই আমি কৃষ্ণাকে সাইকেলে করে খেলতে নিয়ে যেতাম। ওর ইচ্ছা ও জেদের কাছে আমরা হার মেনেই ছেড়েছি। আজ তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই।
কৃষ্ণার বাবা বাসুদেব সরকার বলেন, আমাদের পরিবার তেমনটা সচ্ছল নয়। কৃষ্ণার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে স্কুলের স্যাররা চারটি মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন। তারাই স্কুলে ভর্তি করান। তারাই যাবতীয় খরচ বহন করেন। যখন নিয়মিত খেলা শুরু করল তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছে। আমাদের খুব খারাপ লাগত। মনের কষ্টে কান্না ও রাগারাগি করেছি। বুঝেনই তো, আমরা গ্রামের মানুষ। একপর্যায়ে ভেবেছিলাম ওর খেলা বন্ধ করে দেব। কৃষ্ণা যে এত দূর যেতে পারবে এটা আমরা ও সমালোচকরা কেউ-ই ধারণা করতে পারি নাই।
মা নমিতা রানী সরকার বলেন, দিনের বেশির ভাগ সময় খেলা নিয়ে থাকত, তাই ওকে বকা দিতাম। খেলা বন্ধ করার কথা বললে খেতে চাইত না। লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী থাকলেও ফুটবল যেন ওর প্রাণের নেশা। ওর সাফল্যে আমরা বড়ই খুশি। গ্রামের মানুষ ওকে দেখতে আসে, কথা বলতে আসে, ওর সঙ্গে ছবি তোলে। এখন আর কেউ কিছু বলে না। তিনি আরো বলেন, মেয়ের আয়ে আমাদের সংসার ও ছেলের পড়াশোনা চলে। কৃষিকাজ করে তেমন আয় হয় না। কৃষ্ণার জন্য আশীর্বাদ চাই। ও যেন দেশের জন্য আরো বড় বড় সাফল্য অর্জন করতে পারে।
কৃষ্ণার সাফল্যে তার নিজ গ্রাম থেকে শুরু করে পুরো গোপালপুর উপজেলা ও টাঙ্গাইল জেলায় চলছে উল্লাস-আনন্দ। বৃহস্পতিবার গ্রামে ফেরার পর তার স্কুল ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে করা হয়েছে বরণের আয়োজন। শনিবার টাঙ্গাইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে কৃষ্ণাকে দেওয়া হয়েছে জমকালো সংবর্ধনা, আর্থিক সম্মাননা এবং ক্রেস্ট।
এখনকার অনুভূতি কেমন- এ প্রশ্নে কৃষ্ণা রানী সরকার বলেন, আসলেই এখন আমার সব মিলিয়ে ভালো লাগছে। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্কুলে গ্রামে সবাই সংবর্ধনা দিচ্ছে। আগে এ রকম খুশি হইনি। আপনার এ পর্যন্ত আসার পেছনে কার কার অবদান রয়েছে- আমার ছোট কাকা নিতাই সরকার আমাকে বেশি সাপোর্ট করেছেন। এ ছাড়া মা-বাবা, সাবেক স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক লতিফ স্যার, ক্রীড়া শিক্ষক বাপন স্যার, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং এলাকাবাসী আমাকে সহযোগিতা করেছেন। এ জগতে আসার ইচ্ছা হলো কেন? জবাবে বললেন, আমি ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল ছিলাম। বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়েই গ্রামের মেয়েরা খেলায় আসে। আগে তো আমরা এটা ভাবতেই পারতাম না। প্রাইমারি স্কুলে আমার খেলা দেখে বাপন স্যার আমাকে হাই স্কুলে ভর্তি করান। খেলাধুলার যাবতীয় সরঞ্জাম ও খরচ বহন করেন।
সমালোচকদের সম্পর্কে বললেন, একসময় অনেক কথা শুনেছি। তারাই এখন এসে বলেন, আগে আমরা বুঝতাম না, মেয়েরা এত ভালো করতে পারে। এখন আমি সব ভুলে গেছি। দেশের ফুটবল নিয়ে আপনার ভাবনা কী? যেহেতু আমরা বর্তমানে সাউথ এশিয়ায় ভালো অবস্থানে আছি, সেটা অব্যাহত রাখব। সামনে আশিয়ান গেমস আছে। এটা বড় চ্যালেঞ্জ। যদি কঠোর অনুশীলন এবং শৃঙ্খলার মধ্য থাকতে পারি, তাহলে দেশকে আরো ভালো কিছু উপহার দিতে পারব।
নিজের তারকাখ্যাতি নিয়ে বলেন, আমরা প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। সেখান থেকে উঠে এসে শহরে যাওয়া, দেশের প্রতিনিধিত্ব করা, সব মিলিয়ে ভালোই লাগে। আমার অনুপস্থিতিতে আমার মা-বাবা জাপানের একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন আমার সম্মাননা গ্রহণ করতে। সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম।
গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠাণ্ডু বলেন, একটি অজপাড়াগাঁয়ের কৃষক পরিবারের মেয়ে কৃষ্ণা আজ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কৃষ্ণার আজকের অবস্থানে আসতে সূতি ভিএম সরকারি মডেল পাইলট হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ এবং স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের বিশেষ অবদান রয়েছে। আমি ও আমরা ওর পাশে ছিলাম। ওকে উৎসাহিত করেছি, সহযোগিতা করছি। দরিদ্রতাকে জয় করে উঠে আসা মেধাবী কৃষ্ণার জন্য আমরা গর্বিত। ও যেন দেশের মুখ আরো উজ্জ্বল করতে পারে।
২০১০ সালে উপজেলা পর্যায়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছ মুজিব আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টেই কৃষ্ণার আত্মপ্রকাশ। কৃষ্ণার নেতৃত্বে তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তর পাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। টুর্নামেন্টে কৃষ্ণা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় সূতি ভিএম পাইলট মডেল হাই স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের নজরে পড়েন। আর তার প্রচেষ্টায় এ স্কুলে ভর্তির পর ফুটবল খেলার সুযোগ পেয়ে যান। পরে গোলপুরের সূতি ভিএম পাইলট মডেল হাই স্কুল কৃষ্ণার ফুটবল নৈপুণ্য আর বিশেষ ভূমিকায় জাতীয় স্কুল ও মাদরাসা ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে পরপর তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়। পরবর্তী সময়ে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দল গঠন করা হলে কৃষ্ণাসহ একই স্কুল থেকে আরো দুই কিশোরী দলে স্থান পায়। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে কৃষ্ণার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। পরের বছর ঢাকায় হওয়া এএফসসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দলের অধিনায়কও ছিলেন কৃষ্ণা রাণী সরকার। সেই আসরে আট গোল করে দলকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন। ২০১৭ সালে কৃষ্ণার নেতৃত্বেই থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের মূল পর্বে খেলার গৌরব অর্জন করেছে। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ভারতে হওয়া সাফ ফুটবলে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ।
আপনার মতামত জানান