পিলখানা হত্যাকাণ্ড চূড়ান্ত বিচার এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রায় দেড় দশক আগে ঢাকায় তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সদর দপ্তর পিলখানায় যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তার চূড়ান্ত বিচার এখনো প্রক্রিয়াধীন।
অথচ এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন পাঁচ বছর আগে। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল, লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করা শেষ হয়েছে দুই বছর হয়। এই সময়ের মধ্যে শুধু রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ (কনসাইজ স্টেটমেন্ট) জমা দিয়েছে। আসামিপক্ষ এখনো তা পারেনি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) এ এম আমিন উদ্দিনের ভাবনা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য চলতি বছরই মামলাটি আপিল বিভাগে শুনানিতে ওঠানোর।
বিচারের পূর্বাপর : ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিদ্রোহী জোয়ানদের হাতে মারা যান ৫৭ সেনা কর্মকর্তা। বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান। তখন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে জোয়ানদের বিদ্রোহ। সেই প্রেক্ষাপটে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাম বদলে পরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়।
এ বিদ্রোহের ৫৭টি মামলার বিচার বাহিনীর নিজস্ব আদালতে শেষ হয়। সেই বিচারে ছয় হাজার জোয়ানের কারাদণ্ড হয়। বিদ্রোহের বিচারের পর ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড’ ও ‘বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে’ মামলার বিচার শুরু হয় দেশের প্রচলিত আদালতে।
হত্যাকাণ্ডের মামলায় ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে রায় দেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এ ছাড়া ২৫৬ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস দেওয়া হয় ২৭৮ জনকে।
পরে এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) আসে হাইকোর্টে। পাশাপাশি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষ। বিচারিক আদালতের রায়ে খালাস দেওয়া ২৭৮ জনের মধ্যে ৬৯ জনের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের নভেম্বরে রায় দেন হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৫২ জনের মধ্যে হাইকোর্ট ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। আটজনের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন। পাঁচ আসামিকে খালাস দেন উচ্চ আদালত। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে হাইকোর্ট ১৪৬ জনের সাজা বহাল রেখে ১৪ জনকে খালাস দেন। বিচারিক আদালতের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৬৯টি আপিলের মধ্যে ৩১ জনের খালাস বাতিল করে তাঁদের যাবজ্জীবন এবং চারজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। বাকি ৩৪ জনের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বহাল রাখা হয়। সব মিলিয়ে ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন, চারজনের সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ৫৩ জনকে খালাস দেন উচ্চ আদালত।
রায়ে বলা হয়, ওই ঘটনা (বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড) ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তা-ই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা।
হাইকোর্টের রায়ের তিন বছর পর ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেও ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি তোলার খরচ, অনুলিপি পাওয়ার প্রক্রিয়া, আপিলের পেপারবুক তৈরিতে সময় লেগে যায় প্রায় দেড় বছর।
আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল-লিভ টু আপিল : অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের তথ্য মতে, হাইকোর্টের রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছে বা মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে—এমন আসামিদের সাজা বাড়াতে ৩১টি লিভ টু আপিল করা হয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া ৭৫ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৯ জনের শাস্তি বাড়ানোর আরজি রয়েছে এসব লিভ টু আপিলে।
আসামিপক্ষের এক আইনজীবী বলেছেন, তিনি ৫৩ জন মৃত্যুদণ্ডের আসামির পক্ষে ২৬টি আপিল আর যাবজ্জীবন পাওয়া ১৫১ জনের পক্ষে ২৩টি আপিল করেছেন। বাকি দণ্ডিতদের আপিল ও লিভ টু আপিল সম্পর্কে জানা যায়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আশা করছি, এই বছরই এ মামলার শুনানি করতে পারব। আসামিপক্ষ মামলার আপিলের সারসংক্ষেপ জমা না দেওয়ায় আমরা মামলাটির শুনানি করতে পারছিলাম না। তাদের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য আমরা আদালতে আবেদন করেছি। আদালত নিশ্চয়ই তাদের সময় দেবেন। ওই সময়ের মধ্যে সারসংক্ষেপ তারা দিতে না পারলে আসামিদের আপিল খারিজ হয়ে যাবে।’
গেল বছর আপিল শুনানি শুরু করার কথা বলেছিলেন, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘শুনানি শুরুর বিষয়টি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। গত বছর শুনানি শুরু করতে না পারার কারণ হলো, গত বছর এই মামলার শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পর্যাপ্ত বিচারক ছিলেন না। এখন আপিল বিভাগে যেহেতু আটজন বিচারক আছেন, আশা করি এবার শুনানি হবে।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুনেছি রাষ্ট্রপক্ষ তাদের আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি, আগামী এক মাসের মধ্যেই আমরা আমাদের আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে পারব। সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার পর প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ গঠন করে দিলেই মামলাটি শুনানিতে উঠবে।’
বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ : পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনা যেমন পুরো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল, তেমনি এক মামলায় এত আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশও ছিল নজিরবিহীন। ওই ঘটনায় দুটি মামলার মধ্যে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে হত্যা মামলার রায় হলেও ১৪ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিচারকাজ।
এ মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় এক হাজার ২৬৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এই ১৪ বছরে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে মাত্র ২৫৬ জনের। ২৫৭তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। দুই মামলার আসামি হওয়ায় হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া এবং যাঁদের ১০ বছরের কম সাজা হয়েছে এমন ২৭৮ জন মুক্তি পাননি। ১৪ বছর ধরে তাঁরা জেলে আছেন। বিভিন্ন সময় জামিনের আবেদন করেছি, কিন্তু জামিন হয়নি।’
আপনার মতামত জানান