নোটিশ জারি ছাড়াই নামজারি, অসহনীয় ভোগান্তি

প্রকাশিত

বিধবা আনোয়ারা বেগম দীঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ভূমি অফিসে মিসকেস মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। তাঁর চাচা পিয়ারুজ্জামান অজান্তে প্রায় সাড়ে চার শতাংশ জমি চাচার নামে নামজারি করে নিয়ে যায়। জানতে পেরে নিজের জমি ফিরে পেতে ২০১৮ সালে মিসকেস করেন আনোয়ারা। তার পর থেকেই তার নিয়মিত ঠিকানা সোনারগাঁ উপজেলা ভূমি অফিস। এ রকম শতশত আনোয়ারারা প্রতিদিনই নিজেদের জমি ফিরে পেতে ভীড় করছেন ভূমি অফিসে।

আনোয়ারা জানান, আমার চাচা ভুলক্রমে আমার জমি নামজারি করেছে। বুঝতে পেরে তিনি নিজে এসে ভুল স্বীকার করে জমি আমার নামে ফিরিয়ে দিতে এসিল্যান্ডের বরাবর লিখিত আবেদন করার পরও ছয়মাস ধরে আমাদের শুধু শুধু হয়রানি করছে। দীর্ঘদিনে আমার প্রায় লাখ টাকা খরচ হয়েছে অথচ পূর্বের খতিয়ানে জমি ফিরিয়ে দিচ্ছে না।

ভুক্তভোগী আমির হোসেন জানান, নামজারির পূর্বে বিবাদীর কাছে নোটিশ জারির নিয়ম থাকলেও তারা নোটিশ জারি ছাড়াই নামজারি করে দিচ্ছেন। নোটিশ জারি না করে নামজারি করার সুযোগে মালিকানার রেকর্ড জালিয়াতের মাধ্যমে ভূমিদস্যুতার দৌরাত্ম্য হয়রানির শিকার হচ্ছেন জমির প্রকৃত মালিক।

অভিযোগ পাওয়া যায়, ভূমি অফিসের একশ্রেণির অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট ভুয়া দলিল বানিয়ে ভমির ভুয়া নামজারি খতিয়ান তৈরি করে নিরীহ মানুষের জমি নিজেদের নামে নামজারি করে কম্পানির কাছে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নিজেদের জমি ফিরে পেতে মিসকেস করলেও কোম্পানির টাকার কাছে অসহায় হয়ে বছরের পর বছর ভূমি অফিসে দৌড়াচ্ছেন। ভুয়া নামজারি সহজ হওয়ায় একজনের জমি অন্যজন নামজারি করে নিয়ে যাচ্ছে এতে হয়রানির শিকার হচ্ছে জমির প্রকৃত মালিক- এমনই অভিযোগ করেছেন মিসকেসের হাজিরা দিতে আসা ভুক্তভোগীরা।

মিসকেস হাজিরা দিতে আসা সত্তুরোর্ধ্ব হাজী তাহের আলী ৩৭৭৫নং দলিলে ১৯৯১ সালে তিনি পাইকপাড়া মৌজায় ৩ শতাংশ জমি চেঙ্গাকান্দির নাসির গংয়ের কাছে বিক্রি করেন। পরে তারা ৩৭৭৫ নং দলিলের ক্রমিক নং ব্যবহার করে ২৯ শতাংশের ভুয়া দলিল বানিয়ে ২৯ শতাংশ জমি নামজারি করে নিয়ে যান। তিনি জানান, ভূমি অফিস থেকে যদি বিবাদীর কাছে নোটিশ জারি করে নামজারি করা হতো তবে শেষ বয়সে এসে এতটা হয়রানির শিকার হতাম না।

কাতার প্রবাসী মাতুয়াইলের আজিজুর রহমান জানান, মিসকেস, মিসকেস ফাইল, তদন্ত, জরিপ এবং নিয়মিত হাজিরা দিয়ে একটি মিসকেস মামলার রায় পেতে পঞ্চাশ হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। আবার অনেকে কর্মকর্তাদের সাথে মোটা অংকের অর্থচুক্তি করে হয়রানি থেকে মুক্ত হচ্ছেন। বিদেশ থেকে ফিরলেও ভূমি অফিসে ঘুরেই আমার ছুটির সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।

২০১৮ সালে দায়ের করা ৪৭৮ নং মামলার বাদী বাহাউদ্দিন জানান, বিবাদীরা তাদের নামজারি ভুল হয়েছে মর্মে লিখিত দেওয়ার পরও তৎকালীর নামজারি সহকারি খালেক সরকার ওমেদারের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা দাবী করেন। দাবীকৃত টাকা দিতে না পারায় তার মামলাটি ক্লোজ করে দেন।

উপজেলা ভূমি অফিসে আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সহকারী কমিশনারের যোগদানে অফিসের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে সাধারণ ভূমি মালিকদের কিছুটা হলেও আস্থা ফিরেছে। আগে সপ্তাহে একদিন মিসকেস শুনানি হলেও বর্তমান কমিশনার সপ্তাহে তিনদিন শুনানি করছেন। এতে দ্রুত অনেক মামলার সমাধান হচ্ছে। সবার দাবী একটাই, নামজারির আগে যারা দলিলমূলে মালিক তাদের জমি নামজারির সময় যেন নোটিশ জারি করা হয়, তাহলে প্রকৃত জমি মালিকরা হয়রানির শিকার হবেন না। অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমান এসিল্যান্ড মে মাসে যোগদান করার পর প্রায় আড়াইশত মামলার সঠিক সমাধান করেছেন। বর্তমানে প্রায় পাঁচ শত মামলা চলমান রয়েছে।

সোনারগাঁ উপজেলা ভূমি অফিসে হাজিরা দিতে আসা লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, মিসকেস করলে বাদী বিবাদী উভয় পক্ষ থেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হন কর্মকর্তারা। তারা জানান, ভুয়া নামজারি করে প্রতারক চক্র অন্যের জমি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। জমির প্রকৃত মালিকরা মিসকেস করার পর যাতে জমির মালিক জমি ফিরে না পান সে জন্য প্রতারকচক্র প্রচুর টাকা খরচ করে। এতে জমির প্রকৃত মালিকদের নোটিশ পর্যন্ত গায়েব করে দেন বলে জানান, ভুক্তভোগীরা। তারা জানান, পরপর তিনটি শুনানিতে হাজির না হতে পারলে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিবাদীর পক্ষে রায় দিয়ে দেন। এ কারনে নোটিশ গোপন করার জন্য মোটা অংকের ঘুষ বাণিজ্য চলে।

সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি নাজমুল হুসেইন বলেন, অতীতে কি হয়েছে তা জানি না। ভূমি সংক্রান্ত জটিলতার আবেদনের যথাযত ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি সঠিক সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।

নোটিশ জারির বিষয়ে তিনি বলেন, পুরো উপজেলায় মাত্র একজন জারিকারকের পক্ষে নোটিশ জারি খুব কঠিন। তবে আমি প্রতিটি তহসীল অফিসের নায়েবদের নির্দেশ দিয়েছি যাতে তারা বিবাদীর নিকট নোটিশ জারি করেন।

(সুত্র-কালের কন্ঠ)

আপনার মতামত জানান