নজরদারিতে হেফাজতের আরও ৩৫ কেন্দ্রীয় নেতা
হেফাজতে ইসলামের বহুল আলোচিত নেতা মামুনুল হককে গতকাল দুপুরে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে হেফাজতের ৯ জন কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার হলেন। সংগঠনটির আরও ৩৫ জন নজরদারিতে আছেন, যাঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও শীর্ষস্থানীয় নেতা আছেন অন্তত ২৫ জন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, নজরদারিতে থাকা এসব নেতার প্রায় সবাই ২০১৩ সালে সহিংসতার ঘটনায় কোনো না কোনো মামলার আসামি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার মামলায়ও অনেকে আসামি। ওই তিন দিনের সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭৭টি মামলা হয়েছে। তাতে আসামি ৪৯ হাজারের বেশি। গতকাল পর্যন্ত ৪৫০ জনের বেশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর মধ্যে হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে অন্তত ১৮টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের জন্য গতকাল দুপুর ১২টা থেকেই ঢাকার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার আশপাশের এলাকায় কয়েক শ পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে তিনজনের একটি দল মাদ্রাসার ভেতর থেকে মামুনুল হককে বের করে নিয়ে আসে।
মাদ্রাসার একটি সূত্র জানায়, উপকমিশনার হারুন অর রশিদ প্রথমে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহফুজুল হকের কাছে যান। মাহফুজুল হক হলেন মামুনুল হকের বড় ভাই। পুলিশ কর্মকর্তারা অধ্যক্ষকে বলেন, মামুনুল হক তাঁদের সঙ্গে গেলে সম্মানের সঙ্গে থানায় পৌঁছে দেওয়া হবে। তাঁরা ফিরে গেলে অন্যরা আটক করলে সম্মান না–ও থাকতে পারে। এ সময় মামুনুল হক মাদ্রাসার ভেতরেই ছিলেন। তাঁকে ডেকে আনা হয়। এরপর মামুনুল পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেরিয়ে যান।
গ্রেপ্তারের পর মামুনুলকে প্রথমে শ্যামলীতে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। বেলা দুইটায় নেওয়া হয় তেজগাঁও থানায়। পরে তাঁকে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০২০ সালে মোহাম্মদপুরে একটি ভাঙচুরের মামলায় মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা আছে মতিঝিল থানা, পল্টন থানা ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। পরে সেগুলো সমন্বয় করা হবে। আজ সোমবার মামুনুলকে আদালতে তুলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চাওয়া হবে।
মামুনুল হক হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর কমিটিরও সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব এবং জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরা মোহাম্মদপুর এলাকায় মিছিল করেন। তবে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। দিনভর ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল।
মামুনুল হক ঢাকায় হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অন্যতম। রাজধানীতে হেফাজতের কর্মসূচিতে তিনি দ্রুত জমায়েত করাতে পারেন। উত্তেজক বক্তৃতার জন্য পরিচিত মামুনুল হক সম্প্রতি হেফাজতের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন। তবে ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রয়্যাল রিসোর্টে দ্বিতীয় স্ত্রীসহ ঘেরাও হওয়ার পর মামুনুল হকের একাধিক বিয়ের খবর বের হয়। একের পর এক অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হন তিনি।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ৩ এপ্রিল সোনারগাঁয়ে রিসোর্টের ঘটনার পরদিন মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় খেলাফত মজলিসের নেতারা জরুরি বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে মামুনুল হক উপস্থিত ছিলেন। এরপর তাঁকে সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে লাইভ বক্তব্য ও স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি সক্রিয় ছিলেন। এত দিন তিনি মাদ্রাসাতেই অবস্থান করে আসছিলেন।
মামুনুলের বিরুদ্ধে যেসব মামলা
তেজগাঁও পুলিশ সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৭ মার্চ মোহাম্মদপুর থানায় হওয়া মামলায় মামুনুল হক ৭ নম্বর আসামি। মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে তাঁর বাবার নাম ও ঠিকানা অজ্ঞাত লেখা আছে। মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিংয়ের বাসিন্দা জি এম আলমগীর শাহীন বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন। তিনি আসামিদের বিরুদ্ধে বেআইনি জনতাবদ্ধে এলোপাতাড়ি মারধর, হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত করে গুরুতর জখম, চুরি, হুমকি দেওয়া, ধর্মীয় কাজে ইচ্ছাকৃতভাবে গোলযোগ সৃষ্টি ও প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। একটি মুঠোফোন, সাত হাজার টাকা, ২০০ ডলার এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ডেবিট কার্ড চুরি হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, মামলাটির তদন্ত তাঁরা করছিলেন। তদন্তে মামুনুল হকের সম্পৃক্ততা পাওয়ার পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডিএমপি সদর দপ্তরের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, ডিবির মতিঝিল বিভাগে তদন্তাধীন আটটি মামলা, লালবাগ বিভাগে তদন্তাধীন দুটি মামলা এবং তেজগাঁও বিভাগে তদন্তাধীন একটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মামুনুল হক। এ ছাড়া মতিঝিল থানায় তদন্তাধীন একটি এবং পল্টন থানায় তদন্তাধীন চারটি মামলায় তাঁর নাম রয়েছে। এই ১৬ মামলার মধ্যে ১৫টি মামলাই হয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের পর। এসব মামলার বাদী পুলিশ। ঢাকায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে সর্বশেষ মামলা হয় ৫ এপ্রিল। গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজের পর সংঘর্ষের ঘটনায় এ মামলা করেছেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) উপদপ্তর সম্পাদক খন্দকার আরিফ উজ জামান। মামুনুল হক এ মামলার ১ নম্বর আসামি।
জুনায়েদ আল হাবীব রিমান্ডে
হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবকে গতকাল আদালতে হাজির করে পল্টন থানায় ২০১৩ সালের একটি মামলায় রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
এদিকে গতকালই সাত দিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীর। তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
হেফাজতের প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মামুনুল হকসহ অন্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি তাঁরা আইনগতভাবে মোকাবিলা করবেন।
তালিকায় আরও অন্তত ২৫ শীর্ষ নেতা
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, গত মাসে মোদিবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তারের সম্ভাব্য একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের যেসব নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনো সক্রিয় রয়েছেন, এমন ৩০ জনের একটি তালিকা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। তালিকায় থাকা সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলামাবাদীকে ১১ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে ঢাকার ডিবি পুলিশ। ১৪ এপ্রিল এ তালিকায় থাকা সংগঠনের সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক শাখাওয়াত হোসাইন রাজি, ১৭ এপ্রিল যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবীব ও সহকারী মহাসচিব জালাল উদ্দিন আহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামুনুল হক এ তালিকায় ২ নম্বরে ছিলেন।
তালিকায় হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৩০ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকি ২৫ জন নজরদারিতে আছেন। পর্যায়ক্রমে তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হেফাজতের আমিরের বিষয়ে শিগগির কোনো সিদ্ধান্ত না–ও হতে পারে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন যুগ্ম মহাসচিবকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা আছে।
গ্রেপ্তারের পরিধি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও পুলিশের একটি সূত্র জানায়। ৩০ জনের তালিকায় নাম ছিল না এমন কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদী, কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরীফ উল্লাহ, সহকারী মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি ও ঢাকা মহানগরের নায়েবে আমির জুবায়ের আহমেদের গ্রেপ্তার তারই ইঙ্গিত বহন করে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেছেন, হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে এই গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকবে। দলটির আরও ৩৫ নেতা তাঁদের ‘ওয়াচ লিস্ট’–এ রয়েছেন। পর্যায়ক্রমে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে। সুত্রঃ যুগান্তর।
আপনার মতামত জানান