চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ- তৌহিদ এলাহী
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো কেমন?
আজ থেকে প্রায় দশহাজার বছর পূর্বে মানুষ কৃষিকাজের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে এক জায়গায় থাকা শুরু করে, ধীরে ধীরে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠে। উন্নত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত তিনটি শিল্প বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে। বাষ্প ইঞ্জিন ও রেললাইনের হাত ধরে প্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছিল ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ পর্যন্ত। বিদ্যুৎ ও কনভেয়ার বেল্ট/এসেমব্লি লাইনের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব চালু ছিল বিংশ শতাব্দীর ১৯৬০-১৯৭০ সাল পর্যন্ত। মেইনফ্রেম কম্পিউটার, সুপার কম্পিউটার, পার্সোনাল কম্পিউটার ইত্যাদি প্রযুক্তির মাধ্যমে সংঘটিত হয় তৃতীয় শিল্প বিপ্লব। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, রোবটিক্স্ , আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স , মেশিন লার্নিং , জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, থ্রিডি প্রিন্টিং ইত্যাদির মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটে চলেছে।
সময়টি এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হলেও , পৃথিবীর প্রায় ১৭% মানুষ এখনো দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের নাগাল পায়নি, এবং ৪০০ কোটি মানুষ তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সুবিধা ভোগ করতে পারেনি।
অন্যান্য শিল্প বিপ্লবের সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান পার্থক্য এর দ্রুততা , ব্যাপ্তি ও প্রভাবের গভীরতা। দ্রুত সময়ে তীব্র গতিতে পৃথিবী পাল্টে যাচ্ছে। এসময় প্রধান প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে- সারা পৃথিবী কি একসাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা তুলে নিয়ে আসতে পারবে? নাকি, আগের শিল্প বিপ্লবগুলোর সুবিধাগুলো যেমনটি গ্রহণ করতে পেরেছিল গুটিকয়েক শিল্পোন্নত দেশগুলো, পিছিয়ে পড়েছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো – একই সমস্যা দাঁড়াবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্রেও? ক্রমশ প্রশস্ত হওয়া ধনী-গরিবের ব্যবধান আরো বেশি প্রশস্ত হবে কি?
পৃথিবীর সবাই মিলে একসাথে কিভাবে আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে পারি এবং নতুন এ বিপ্লবের প্রভাব মোকাবেলা করতে পারি তার উপর এ প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ভর করছে ।
মিস্টার ক্লাউস সোয়াব তার ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভলিউশন’ বইতে বলেছেন, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ডিজিটাল টেকনোলজি, এবং জীববিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান চালিকাশক্তি। রোবটিক্স্ , আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স , মেশিন লার্নিং, ইন্টার্নেট অফ থিংস, স্বচালিত গাড়ি, মোবাইল সুপার কম্পিউটিং, নিউরোসায়েন্সের অ্যাডভান্স গবেষণা আমাদের শিল্প উৎপাদন এবং মানুষ হিসেবে জীবনধারণের পদ্ধতিকেই আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছে। আর এ পরিবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর জন্য এক মহান সম্ভাবনার অথবা এক সম্ভাব্য দুর্যোগের। অদূর ভবিষ্যতে, আরো কয়েক শতকোটি মানুষ সংযুক্ত হয়ে যাবে ডিজিটাল নেটওয়ার্কে, সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বাড়বে অনেকগুণ বেশি, একসাথে আরো অধিক রিসোর্স ম্যানেজ করতে পারবে, প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষত রাখতে পারবে- এমনকি পূর্বের শিল্পবিপ্লবগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ আবার পুনর্বহাল হবে। উৎপাদিত বস্তুগুলো দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে; সেন্সরের মাধ্যমে মনিটরিং ও ম্যানেজমেন্ট করায় হিসেবের খাতায় ডেপ্রিসিয়েশন বা অবচয়ন শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। অন্যদিকে, সংগঠনগুলো পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে অক্ষম হলে, নতুন বিপ্লবের সঠিক ফল আনয়নে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারে সরকারগুলো ব্যর্থ হতে পারে – তখন দেখা দিবে নিরাপত্তাহীনতার সমস্যা। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়বে, সমাজ ভাগ হয়ে যাবে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কালে ধীরে ধীরে মানুষের সকল পরিধেয়- কাপড়, চশমা, ঘড়ি সকল কিছু ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও ঘরে-বাইরে ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র, পানির লাইন, বিদ্যুৎ লাই্ন, সুয়ারেজ লাইন সকল কিছুই ইন্টারনেটে সংযুক্ত সেন্সরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সকলের আনলিমিটেড ডাটা স্টোরেজ করার সুযোগ হবে। ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে বড়-ছোট নানা বস্তু থ্রিডি প্রিন্টিং এর মাধ্যমে কম্পিউটারের কমান্ডে তৈরি হবে । অটোমেটিক ডাটা পাওয়ায় আদমশুমারির প্রয়োজন হবে না। সকলের কম্পিউটার-ইন্টারনেট- স্মার্টফোন থাকবে, গাড়িগুলো ড্রাইভারবিহীন হবে। অডিট-হিসেব-ট্যাক্স কালেকশনের কাজ কম্পিউটার করে দিবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ব্লকচেইন এর মাধ্যমে। থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে তৈরিকৃত মানুষের কৃত্রিম অঙ্গসমূহ ্দিয়ে অসুস্থ অঙ্গ রিপ্লেস করা যাবে। রোবট সৈনিক বোমা মারবে, ন্যানো রোবট শরীরে ঢুকে ভাইরাস ধ্বংস করে রোগের চিকিৎসা করবে। ব্যক্তিগত বাড়ি-গাড়ির চেয়ে শেয়ার করা (উবার/এয়ার বিএনবি) বাড়ি-গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যাবে । যানবাহনগুলো মেশিন লার্নিং ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর মাধ্যমে সুচারুরূপে পরিচালিত হবে এবং কোন ট্রাফিক লাইট এর প্রয়োজন হবে না। জিডিপিতে ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার কর্পোরেট বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এ মেম্বারের মতো কাজ করবে। এসকল বিষয় ১/২ বছরের মধ্যে না হলেও খুব শীঘ্রই আমরা এ নতুনত্বের স্বাদ পেতে যাচ্ছি।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কালে, উৎপাদন ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ স্বাধীন, বেশিরভাগ প্রচলিত কাজগুলো নাই হয়ে যাচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত দেয়ার অপূর্ব ক্ষমতা তৈরি করছে , অনেক কাজ মানুষের ন্যূনতম সংস্পর্শ ছাড়াই করে ফেলছে। সফটওয়্যার আইকিউ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষের ইনপুট কমে যাচ্ছে। প্রশাসন, আই্ন, চিকিৎসা, ড্রাইভিং, নির্মাণ শ্রমিক, এমনকি যুদ্ধের সৈনিকসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে মানুষের প্রয়োজনীয়তা কমে যাচ্ছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দৃশ্যমান প্রধান সমস্যা হয়ে যাবে নির্বিচারে চাকরি হারানো। আগামী এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০% কাজ মানুষের শ্রম বাদ দিয়ে যন্ত্রের মাধ্যমে অটোমেটেড হয়ে যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের সঠিক ভূমিকা রাখার সুযোগ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। শুধু তাই নয়- আমাদের কাজের ধরন, যোগাযোগের ধরন, এমনকি বেঁচে থাকার ধরনটিও পরিবর্তন হয়ে যাবে। সব ধরনের পেশা-শিল্প-ব্যবসা ডারউইনের সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট তত্ত্বের মধ্যে পড়ে যাবে-এর মধ্যে যেগুলোর উদ্ভাবনী শক্তি বেশি থাকবে সেগুলোই শুধু টিকে যাবে।
একসাথে সবাই মিলে চতুর্থ বিপ্লবের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে এ মুহূর্তে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হাওয়াই উচিত আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমাদের উন্নয়নের পথ নকশাটিতে বিচিত্র মানুষ এবং সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে একসাথে নিয়ে এ চ্যালেঞ্জকে ভয়হীনভাবে মোকাবেলা করতে হবে। দেশ-জাতি, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, ধনী-গরীব , উন্নত- অনুন্নত নির্বিশেষে চতুর্থ বিপ্লবের এ সুযোগকে পৃথিবী ও মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। পূর্বের শিল্প বিপ্লব গুলোতে তৈরিকৃত ক্ষত, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমানোর এক অপূর্ব সুযোগ করে নিতে পারি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জকে সঠিকভাবে দক্ষ মোকাবেলার মাধ্যমে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই বইটির সহযোগী হিসেবে আমি আরও দুটি বই পড়ার অনুরোধ করছিঃ Homo Deus; 21 lessons for 21st Century by Yuval Noah Harari
আপনার মতামত জানান