কোরআন হিফজ করার পদ্ধতি
আল্লাহর দেওয়া সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ কিতাব আল কোরআনুল কারিম হেফজকারীরা ও সংশ্লিষ্টরা বিশেষভাবে সম্মানিত। এই খিদমত আঞ্জাম দেওয়া হাফিজিয়া মাদরাসার পাঠদান ও মুখস্থকরণ পদ্ধতি নিয়ে বেশ আলোচনা ও সমালোচনা লক্ষ করছি। এই প্রেক্ষাপটে আমার কিছু ভাবনা তুলে ধরছি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্পূর্ণ কোরআনের হাফেজ না হওয়ায় অনেক মনঃকষ্টে ভুগি।
দাখিল, আলিম থেকে অনার্স, এরপর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য মালয়েশিয়া ও কুয়েতের বিশ্ববিদ্যালয়, সবখানেই আমার এই মনোবেদনা বহন করেছি? মালয়েশিয়া ও কুয়েতে অধ্যয়নের সময় দেখেছি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান সহপাঠী বন্ধুরা সবাই এবং অন্যান্য দেশের বন্ধুদের বেশির ভাগ হাফিজে কোরআন। আগ্রহবশত তাদের দেশের হিফজের পদ্ধতি নিয়ে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছি সেখানের হিফজুল কোরআনের পদ্ধতি সম্পর্কে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত হিফজের সব পদ্ধতিকে তিনটি মৌলিক পদ্ধতিতে শ্রেণিভুক্ত করা যায়।
১. সম্পূর্ণ আবাসিক পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে হিফজুল কোরআনে প্রয়াসী ছাত্রদের সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থাপনায় রেখে শুধু এর পেছনেই তাদের মেধা কাজে লাগানো হয়। ভারত উপমহাদেশ ও আফ্রিকার কিছু রাষ্ট্রে এ ব্যবস্থা চালু আছে। আমরা আবহমানকাল ধরে এ ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত। কোরআন শিক্ষার জন্য আহলে সুফফার সার্বক্ষণিক মসজিদে নববীতে অবস্থানের ওপর কিয়াস করে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে বলে মনে করা হয়।
২. মসজিদভিত্তিক পদ্ধতি
সাধারণত জোহর/আসর থেকে মাগরিব/ঈশা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চালু থাকে। শিক্ষার্থীরা সকালে অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে এবং বিকেলে এখানে এসে হিফজুল কোরআনে প্রয়াসী হয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্য আরব রাষ্ট্রে এ ব্যবস্থার আধিক্য দেখা দেয়। তবে বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে এ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আমরা আরব স্কলারদের জীবনী পড়লে তাঁদের হিফজুল কোরআন সম্পন্ন করার স্থানে মাদরাসার নামের পরিবর্তে জামে মসজিদের নাম দেখি। কারণ তাঁরা ওই সব মসজিদ থেকে হেফজ সম্পন্ন করেছেন।
৩. স্কুল/মাদরাসাভিত্তিক পদ্ধতি
স্কুল বা মাদরাসার সাধারণ পাঠক্রমের সঙ্গে হিফজুল কোরআনকে একীভূত করে একটি পর্যায়ের মধ্যে হিফজুল কোরআন সম্পন্ন করানো হয়। এ আধুনিক পদ্ধতিটি বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি আছে। বাংলাদেশে কিছু মাদরাসার পাশাপাশি বর্তমানে কিছু স্কুল এমনকি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও এ পদ্ধতি চালু করেছে।
হিফজুল কোরআনের প্রচলিত তিনটি পদ্ধতিতে প্রতিবছর হাজার হাজার হাফেজ হচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ। প্রতিটি পদ্ধতি কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং এককভাবে কোনো পদ্ধতিকে অকার্যকর বললে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হবে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে প্রতিটি পদ্ধতি দৃশ্যমান গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আরো সুন্দর ও গোছানো ব্যবস্থাপনার জন্য সংস্কার বা আধুনিকীকরণের প্রস্তাবনা পেশ করা যেতে পারে?
যে বা যারা আবহমানকাল ধরে চলে আসা হিফজখানা পদ্ধতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন তাঁদের উচিত হবে সংস্কারের জন্য যুক্তিপূর্ণ, বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবমুখী পদ্ধতির প্রস্তাব পেশ করা। বিশেষ করে যারা পাবলিক ফিগার, প্রাজ্ঞ, আন্তরিক ও সময়সচেতন তারা এ বিষয়ে অগ্রণী ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
আমাদের দেশে প্রচলিত যে পদ্ধতি আছে, তা কারো কাছে অসম্মত মনে হলে তিনি বিকল্প হিসেবে অন্য দুটির যেকোনো একটি বা নতুন কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মসজিদভিত্তিক হিফজব্যবস্থা বেশি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। বাংলাদেশে এ পদ্ধতিটি নেই বললেই চলে। এখানে এই পদ্ধতিটি এগিয়ে নেওয়া যায়। এ দেশে হাজার হাজার মসজিদ আছে। এসব মসজিদে যদি হিফজের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে সহশিক্ষার পাশাপাশি প্রতিবছর হাজার হাজার হাফেজ মসজিদভিত্তিক হিফজখানা থেকে বের হতে পারে। বিশেষ করে যারা কিছু অংশ হিফজ করতে চায় যেমন ৫-১০ পারা তাদের জন্য এ ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা হলো: মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন যদি হাফেজ হন, তাহলে শিক্ষক হিসেবে তাঁদের কাজে লাগানো সহজ হবে।
সর্বশেষ অনুরোধ, আমরা যেন কোনো ব্যবস্থাকে সরাসরি অকার্যকর না বলি; বরং তার সমস্যা ও অন্তরায়গুলো আগে চিহ্নিত করি এবং সমাধানের করণীয় নির্ধারণ করি। প্রয়োজনে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নতুন কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার বা নতুন কোনো পদ্ধতি প্রণয়নের মাধ্যমে পুরনো পদ্ধতির সংস্কার করা যেতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি এখানে দ্বিতীয় যে পদ্ধতি উল্লেখ করেছি এটাকে সমর্থন জানাই। তার অর্থ এই নয় যে বহুল প্রচলিত প্রথম পদ্ধতিটি অকার্যকর। তবে আমি মনে করি এ দেশে দ্বিতীয় পদ্ধতিটি চালু করা গেলে হিফজের প্রসার আরো বৃদ্ধি পাবে এবং আরো একটি সফল হিফজব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবকে ধারণ ও সে অনুযায়ী আমাদের জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন
আপনার মতামত জানান