কাতার বিশ্বকাপের দরজা খুলছে আজ

প্রকাশিত



বিতর্ক আর বিশ্বকাপ। কাতারে এসে দুই-ই যেন মিলেমিশে একাকার! কেউ কাউকে পেছনে ফেলতে পারছে না। দুইয়ের দৌড়ঝাঁপে আজ বিশ্বকাপ ফুটবলের নতুন মিশন শুরু হচ্ছে কাতারে।

বিশ্বকাপের ‘মিশন কাতার’ চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই এর সঙ্গী হয়েছে বিতর্ক।



সর্বশেষ সংযুক্তি হলো, আজ উদ্বোধনী ম্যাচের আগেই কাতারের বিপক্ষে অভিযোগ উঠেছে তারা নাকি ইকুয়েডরের আট ফুটবলারকে কিনে নিয়েছে! বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ জিততে কাতার গোপনে ৭.৪ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে ওই ফুটবলারদের। মারাত্মক অভিযোগ। এর আগে পেট্রো-ডলারের বিনিময়ে বিশ্বকাপ কিনে নেওয়ার বিতর্ক তো আছেই কাতারের বিরুদ্ধে। সাবেক ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটারও এখন স্বীকার করছেন, কাতারে বিশ্বকাপ দেওয়া বড় ভুল ছিল। এরপর স্টেডিয়াম তৈরিতে অসংখ্য নির্মাণ শ্রমিকের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু নিয়ে বিশাল আলোড়ন আছে বৈশ্বিক ফুটবলে। যে ফুটবল মানবতার, যে ফুটবল আনন্দের, সেটার জন্য মৃত্যুর মিছিল হবে—এটা নিয়েই সরব অনেকে। এ নিয়ে সোচ্চার মানবাধিকার সংস্থাগুলোও। কয়েকটি দলের অধিনায়কও ঘোষণা দিয়েছেন মাঠে প্রতিবাদ জানাবেন বলে। এসব দেখলে মনে হবে, কাতার বিশ্বকাপটা বুঝি ফুটবলের নয়; বিতর্কেরও বিশ্বকাপ!

এটাও ঠিক যে ফুটবলের হাওয়াটা চারদিকে বইতে শুরু করেনি। স্থানীয়দের জীবনে ফুটবল যে খুব দোলা দিয়েছে, এটাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ইউরোপে কিংবা আমেরিকার মতো বড় দেশে বিশ্বকাপ হলে বিভিন্ন শহরে দোলা দিয়ে যায় ফুটবল। মাতিয়ে রাখে আমজনতাকে। কাতারের মতো ছোট দেশে হচ্ছে বলে সেটা আরো রঙিন হওয়ার কথা ছিল। হয়েছে উল্টো, ঘরের মানুষ (প্রবাসীদের ক্ষেত্রে) বে-ঘর হয়েছে। কাজের মানুষকে কাজ ছাড়তে হয়েছে। সে কারণেই কিনা দোহার পথঘাট দেখে বোঝার উপায় নেই যে মাত্র ২৪ ঘণ্টা পরই মাঠে গড়াচ্ছে বিশ্বকাপ!

তবে আয়োজকদের অর্থব্যয় আর আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। আটটি স্টেডিয়ামে হবে বিশ্বকাপ আর প্রতিটি স্টেডিয়াম কাতারি ফুটবলের একেকটি মনুমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্থাপত্য নকশা আর আধুনিকতায় ছাড়িয়ে যেতে পারে যেকোনো ফুটবলীয় দেশের নামি স্টেডিয়ামগুলোকে। কোথাও এতটুকু ঘাটতি নেই। ২০০ বিলিয়ন ডলারের এই বিশ্বকাপে আয়োজকদের তরফ থেকে কোনো ঘাটতি নেই। সমর্থকদের জন্য ‘ফ্যান জোন’ করা হয়েছে, সেখানেও রাখা হয়েছে সব ব্যবস্থা। কাতারি রাজপরিবারের নির্দেশে স্টেডিয়ামে মদ-বিয়ার বন্ধ হয়ে গেলেও এই পানীয় পাওয়া যাবে ফ্যান জোনগুলোতে। সন্ধ্যা হলেই সেই জোনগুলোতে হাজির হচ্ছেন ভিনদেশিরা। রাতের আলোয় খাওয়াদাওয়া-আনন্দ-আড্ডায় জমতে শুরু করেছে ফ্যান জোনগুলো।

আজ বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গেলে হয়তো আরো জমে যাবে। মেসি-রোনালদো-নেইমার-এমবাপ্পেরা মাঠে নেমে গেলে নিখাদ ফুটবলে বুঁদ হয়ে যাওয়ার কথা সবার। সবুজ ক্যানভাসে মজে যাবে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া বাধিয়ে গতকাল কাতার এসেছেন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। ৩৭ বছর বয়সে ফুটবলটা আর আগের মতো বশে থাকে না তাঁর। এর পরও তিনি মাঠে নামতে মরিয়া, ম্যানইউ কোচ টেন হাগ সেই সুযোগ দিচ্ছেন না বলেই বিবাদ। ইংলিশ সাংবাদিকরাও মনে করেন, রোনালদোর পায়ের আঁচড়ে বিশ্বকাপও সেভাবে রঙিন হবে না।

মেসি এখনো অবশ্য ফুটবল নিয়ে খেলছেন রঙের খেলা। বিশ্বকাপও যেন তাঁর মাঠে নামার জন্য অপেক্ষায় আছে। রোজারিওর জাদুকরের পায়ে ফুটবল শিল্পিত রূপ পেলে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এগোবে দুর্বার গতিতে। কিন্তু সেই গতি থামানোর ঘোষণা দিয়েছেন নেইমার। ব্রাজিলের এই ফরোয়ার্ডের শয়নে-স্বপনে বিশ্বকাপ এবং মেসির আর্জেন্টিনাকে থামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। এই ত্রয়ীকে ছাড়িয়ে যেতে তৈরি কিলিয়ান এমবাপ্পে! রাশিয়া বিশ্বকাপের ‘সেরা তরুণ’ ফুটবলারটি আছেন ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। কাতার রাঙিয়ে এই ফরাসি ফুটবলার হতে চান বিশ্বকাপের মহানায়ক। দারুণ সময় যাচ্ছে তাঁর সতীর্থ করিম বেনজিমার, সদ্য ব্যালন ডি’অর জয়ী রিয়াল মাদ্রিদের ফরোয়ার্ড ক্যারিয়ারের পূর্ণতা দেখছেন বিশ্বকাপ জয়ে।

কিন্তু বিশ্বকাপ এক রোমাঞ্চকর জাদুর বাক্স। ফুটবল দেবতা সেখানে কী লুকিয়ে রেখেছেন, কার জন্য কতটা রেখেছেন বলা কঠিন। নইলে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে ‘দ্য ফেনোমেনন’ রোনালদোই বা হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়বেন কেন? ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ট্রফির এত কাছে গিয়েও কেন লিওনেল মেসিকে কান্নায় শেষ করতে হয়? এসব কেনর কোনো জবাব নেই। এটা আদালতের সওয়াল-জবাবের রায় নয় যে বিচারক সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডা তুলে রাখবেন। এটা মাঠের ম্যাজিক, পুরো মাঠ দাপিয়ে শেষে যে কেউ ট্র্যাজিক নায়ক হয়ে যেতে পারে। আবার মুহূর্তের ঝলকে কেউ হয়ে উঠতে পারেন মহানায়ক। তাইতো এটা এত রোমাঞ্চকর। তারকাদের ভুলে ফুটবল দেবতা মজে যেতে পারেন যেকোনো তরুণের সুভাসিত ফুটবলেও। সেই রোমাঞ্চকর ফুটবল সুরভির খোঁজে আজ শুরু হচ্ছে এক মাসের ফুটবল মহাযজ্ঞ, যেখানে বিতর্ক আর বিশ্বকাপের লড়াইয়েরও ফায়সালা হবে।

আপনার মতামত জানান