করোনা মোকাবেলায় ভিটামিন ডি

প্রকাশিত

কভিড-১৯-এর চিকিৎসায় বিশ্বে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে মেডিক্যাল সায়েন্স বলছে, যেকোনো রোগ প্রতিরোধের জন্য দেহের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকা দরকার। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো রাখার ক্ষেত্রে ভিটামিন ‘ডি’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ
বেশ কিছু খাদ্যপ্রাণের মধ্যে শরীরের দ্রবণীয় চর্বিজাতীয় (ফ্যাট সলিউবল) গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপ্রাণ হলো ভিটামিন ‘ডি’। অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণ করা, আয়রন ও ম্যাগনেসিয়াম দ্রবীভূত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করে এই গ্রুপের ভিটামিন। বিশেষ করে ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী রাখে বলে ক্ষতিকর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও রুখতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া হাড় ও দাঁতের সুরক্ষা, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা রোগের ঝুঁকি কমাতে এর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

করোনায় ভূমিকা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ভিটামিন ‘ডি’র অভাব থাকলে তার বেশি ক্ষতি হতে পারে। করোনাভাইরাসের সঙ্গে শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এতটা লড়াই করে যে ‘সাইটোকাইন স্টর্ম’ নামের প্রদাহ দেখা দেয়। এই প্রদাহ শরীরের ভালো কোষগুলো ধ্বংস করতে পারে। আর এই প্রদাহ কমানোর বেশ ক্ষমতা রয়েছে ভিটামিন ‘ডি’র।

অন্যদিকে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়নি, বিশেষ করে কালো ত্বকের ব্যক্তিদের বেশি পরিমাণে ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করে স্বাভাবিক লেভেল বজায় রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে।

গবেষণা কী বলছে?
সম্প্রতি শিকাগো মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের শরীরে যথেষ্ট মাত্রায় ভিটামিন ‘ডি’ আছে, তাদের কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। বিশেষত কালো ত্বকের লোকদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি। গত ১৯ মার্চ জ্যামা ওপেন নেটওয়ার্কে কভিড-১৯ পজিটিভ রোগী ও ভিটামিন ‘ডি’ সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, শরীরে ৩০-৪০ ন্যানোগ্রাম/মিলি ভিটামিন ‘ডি’ থাকা কালো ত্বকের ব্যক্তি থেকে ৪০ ন্যানোগ্রাম/মিলি বা এর অধিক ভিটামিন ‘ডি’ থাকা ব্যক্তিদের কভিডে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় আড়াই শতাংশ কম। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, ৮০ শতাংশ কভিড সংক্রমিত ব্যক্তি ভিটামিন ‘ডি’ স্বল্পতায় ভুগছে।

উপসর্গ
ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে তা হলো :

► ক্লান্তি ও অবসাদ।

► হাড় ও পেশিতে ব্যথা, পেশি দুর্বল, হাড় ক্ষয় ইত্যাদি।

► বিষণ্নতা বা মন খারাপ হওয়া।

► অত্যধিক চুল পড়া।

► ঘা শুকাতে দেরি হওয়া ইত্যাদি।

লেভেল বা মাত্রা জানা জরুরি
কারো শরীরে ভিটামিন ‘ডি’র অভাব আছে কি না তা বোঝার সবচেয়ে সঠিক পরীক্ষা হলো ২৫ হাইড্রক্সি ভিটামিন ‘ডি’ ব্লাড লেভেল পরীক্ষা করা। এই পরীক্ষার ফলাফলে ভিটামিন ‘ডি’র লেভেল ২৯ ন্যানোগ্রাম/মিলি থেকে ৫০ ন্যানোগ্রাম/মিলি হলে বুঝতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ‘ডি’ আছে। অন্যদিকে ২০ ন্যানোগ্রাম/মিলি বা আরো কম হলে বুঝতে হবে ব্যক্তিটি ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে ভুগছে।

কতটুকু দরকার?
বয়সভেদে প্রত্যেক মানুষের দেহে ভিটামিন ‘ডি’র প্রয়োজনীয়তারও তারতম্য রয়েছে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৪০০ থেকে ৬০০ আইইউ (একটি আন্তর্জাতিক ইউনিট, যা চর্বি দ্রবণীয় ভিটামিন পরিমাপে ব্যবহৃত হয়) ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করা দরকার। আর যদি সূর্যের সংস্পর্শে কম থাকা হয়, তবে ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণের পরিমাণ হবে ১০০০ আইইউ। তবে ১০০০ আইইউর অধিক ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করলে হাইপারক্যালসেমিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। যদিও ভিটামিন ‘ডি’ সাপ্লিমেন্ট খাওয়া নিরাপদ, তবে অত্যধিক ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণে রক্তপ্রবাহে ক্যালসিয়াম বেড়ে যায়। ফলে বমি বমি ভাব, দুর্বলতা, ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে। কিডনিতে পাথরও হতে পারে।

প্রধান উৎস সূর্যালোক
তিনটি উপায়ে ভিটামিন ‘ডি’র ঘাটতি পূরণ করা যায়। যেমন :

১. পর্যাপ্ত সূর্যের এক্সপোজার নিশ্চিত করা। ২. ভিটামিন ‘ডি’-সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ। ৩. ভিটামিন ‘ডি’ পরিপূরক বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ।

তবে ৮০ শতাংশ ভিটামিন ‘ডি’ আসে সূর্যালোক থেকে বাকি ২০ শতাংশ আসে খাদ্য থেকে। হাড় তৈরি, হাড়ের গঠন ঠিক রাখার পাশাপাশি এটি পাচনতন্ত্রে ক্যালসিয়াম সঠিক শোষণ, প্রদাহ হ্রাস ও ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। এর ঘাটতিতে শিশুদের রিকেটস, বড়দের অস্টিওম্যালেসিয়া, অস্টিওপরোসিস, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ক্যান্সারের ঝুঁকি, প্রজননব্যবস্থা দুর্বল করাসহ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে। ভিটামিনগুলোর মধ্যে একে পাওয়ার হাউস পুষ্টি উপাদান বলে। এর মূল উৎস সূর্যের আলো বলে একে সানশাইন ভিটামিনও বলা হয়। এটি প্রি-ইনফ্ল্যামেটর যৌগের উৎপাদন হ্রাস করে, যা শ্বাসনালির সংক্রমণ, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অন্যান্য ভাইরাসের ঝুঁকিও হ্রাস করতে পারে। যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ‘ডি’ মেলে, তাই এর ঘাটতির প্রধান কারণ সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকা।

পর্যাপ্ত সূর্যের আলো গায়ে পড়লে ইউভিবি রশ্মি ত্বকের ইপিডার্মিশ স্তরে থাকা ডিহাইড্রোকোলেস্টরলকে কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় লিভার ও কিডনির সাহায্যে ভিটামিন ‘ডি’তে পরিণত করে। ত্বকে পর্যাপ্ত সূর্যের সংস্পর্শে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘ডি’ তৈরি হয়। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ মিনিট রোদের সংস্পর্শে থাকলে ১০০০ থেকে ১৫০০০ আইইউ ভিটামিন ‘ডি’ পাওয়া যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্নতায় ভুগছে এমন মানুষের শরীরে দুই সপ্তাহ সূর্যের আলো লাগালে তাদের যথেষ্ট উন্নতি মেলে। অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু-কিশোর খোলা পরিবেশে সূর্যের আলোতে বাইরে ছিল তাদের মায়োপিয়া বা ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যা ছিল না। আর যেসব শিশু ঘরের বাইরে কাজকর্মে কম অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মায়োপিয়ার সমস্যা ছিল। তবে সূর্যের ক্ষতিকর ইউভি রশ্মি থেকে রক্ষা পেতে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত।

সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ

আপনার মতামত জানান