এসপির ইয়াবা কারবার, ৩ লাখ পিস বিক্রির গোমর ফাঁস

অবিশ্বাস্য হলেও খোদ পুলিশ সুপারের সম্মতি নিয়েই বড় ধরনের ইয়াবা চালান বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রির মোটা অঙ্কের টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন এসপিসহ পুলিশের দুর্নীতিপরায়ণ কতিপয় সদস্য। এমনকি ঘুসের ভাগ হিসাবে সোর্স নামধারী চাকরিচ্যুত দুই পুলিশ কনস্টেবলকে দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা। অভিযানে আটক হওয়া চারজনের মধ্যে তিন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে ছেড়েও দেওয়া হয়। গত ৬ জানুয়ারি চাঞ্চল্যকর এমন ঘটনাটি ঘটেছে দেশের ইয়াবা প্রবেশের অন্যতম রুট হিসাবে পরিচিত কক্সবাজারের রামুতে।
এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন ভয়াবহ অপরাধের ঘটনা ধরা পড়ার পর প্রথমে অস্বীকার করেন অভিযুক্তরা। তবে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ থাকায় পরে প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার অপচেষ্টা করেন খোদ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ। এসপির নির্দেশে ডিবির ওসি জাহাঙ্গীর আলম প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে সব অভিযোগ স্বীকার করেন এবং রিপোর্ট বন্ধ করতে ব্যাগভর্তি মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে আসেন। যুগান্তরের হাতে রিপোর্টের সপক্ষে অন্য প্রমাণাদি ছাড়াও এসপি, দুজন এএসপি এবং ওসিসহ বেশ কয়েকজনের ৫০ মিনিটের অডিও রেকর্ড সংরক্ষিত আছে।
আত্মসাৎ ও বিক্রি হয় যেভাবে : তথ্যানুসন্ধান ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৬ জানুয়ারি ভোরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ টয়োটা কোম্পানির ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়ি (নম্বর : ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৬২০৯) জব্দ করা হয়। এ সময় গাড়িতে থাকা ৪ জনকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা শাখার ওসি জাহাঙ্গীর আলম ও এসআই সমীর গুহের নেতৃত্বে ডিবির একটি অভিযানিক টিম। তবে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে তাৎক্ষণিক তিন ইয়াবা কারবারিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গুরুতর এ অপরাধ আড়াল করতে অভিযানে দেখানো হয় চকরিয়া থানাধীন ডুলহাজারার ইউনিয়ন। সেখানে ১ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা জব্দ এবং ইয়াবা বহনকারী গাড়ির চালক ইসমাইলকে গ্রেফতার দেখিয়ে চকরিয়া থানায় একটি মামলা করা হয় (মামলা নং- ১৬)। মামলার বাদী করা হয় এসআই সমীর গুহকে। নিয়মানুযায়ী জব্দ করা গাড়ি চকরিয়া থানায় হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু তা না করে জেলা পুলিশ লাইনে এনে রাখা হয়।
অভিযানে ডিবির ওসি জাহাঙ্গীর আলম, এসআই সমীর গুহ, কনস্টেবল/৫১১ জাহিদ হাসান, কনস্টেবল/১৩৭৩ মো. সাইফুল হাসান, কনস্টেবল/১১৯১ রেজাউল করিম, কনস্টেবল/৬৫৬ মোহাম্মদ ইরফান (ওসি ডিবির একান্ত মুন্সি) এবং রিয়াজ মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। যারা সবাই মাদক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত এবং টাকার ভাগ নিয়েছেন।
এদিকে অভিযান ধামাচাপা দিতে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো প্রেস রিলিজ বা সংবাদ সম্মেলন করা হয়নি। অথচ ৫০০ পিস ইয়াবা জব্দের ঘটনায় কক্সবাজার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ অন্তত ২০ জন সাংবাদিককে নিউজ করার জন্য প্রেস রিলিজ পাঠান। কিন্তু সম্প্রতি ৫ লাখ ইয়াবা চালান আটকের পর কোনো সাংবাদিককে জানানো কিংবা কোনো প্রেস রিলিজও দেওয়া হয়নি। ফলে সংবাদমাধ্যমে অভিযানের খবর প্রকাশিত হয়নি। এ রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়েই পুলিশের মাদক বিক্রির ভয়ানক তথ্য যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
ভাগাভাগিতে কনস্টেবল থেকে পুলিশ সুপার : দীর্ঘ অনুসন্ধানে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওইদিন ডিবি অভিযানে মোট ৩৫ কাট ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ইয়াবার প্রতি প্যাকেটকে ‘কাট’ বলা হয় এবং প্রতি কাটে ১০ হাজার পিস ইয়াবা থাকে। অর্থাৎ ৩ লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা আত্মসাৎ করে পুলিশ। যার বর্তমান বাজারমূল্য পিসপ্রতি ৩০০ টাকা হিসাবে মোট ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আত্মসাৎ করা ইয়াবা থেকে অভিযানে সহযোগী সোর্স হিসাবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের চাকরিচ্যুত দুজন কনস্টেবলকে ১৩ কাট (১ লাখ ৩০ হাজার পিস) দিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ সূত্র বলছে, এসপির অনুমতি পাওয়ার পর বাকি ২ লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবা তড়িঘড়ি করে পিসপ্রতি ৯৫ টাকা করে ২ কোটি ৯ লাখ টাকায় ঘনিষ্ঠ কারবারিদের কাছে বিক্রি করে ডিবি। ইয়াবা বিক্রির দায়িত্ব পালন করে ওসি ডিবির ড্রাইভার কাম কনস্টেবল/২২৭৮ রিয়াজ মাহমুদ। মাদক বিক্রির ২ কোটি ৯ লাখ টাকা থেকে অভিযানে অংশ নেওয়া ৪ জন কনস্টেবল-জাহিদ হাসান, মো. সাইফুল হাসান, রেজাউল করিম এবং মোহাম্মদ ইরফানকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে মোট ৩০ লাখ টাকা এবং ইয়াবা বিক্রির দায়িত্ব পালন করায় ড্রাইভার কনস্টেবল রিয়াজকে ১০ লাখ টাকাসহ মোট ৪০ লাখ টাকা ভাগবাঁটোয়ারা হয়।
অপরদিকে পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহকে ডিবি ওসি জাহাঙ্গীর আলম জানান, ২ লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবা ৫৫ টাকা রেটে বিক্রি করে মোট ১ কোটি ২১ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এরপর পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহকে ৩০ লাখ টাকা এবং বাকি ৯১ লাখ টাকা ডিবির টিমের ৭ জন সদস্যের মধ্যে ভাগ করার কথা জানানো হয়। এতে প্রমাণিত যে, পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ শুরু থেকে পুরো বিষয়টি অবগত রয়েছেন। তবে ২ কোটি ৯ লাখ টাকার মধ্যে ৭০ লাখ টাকা বণ্টনের পর ওসি ডিবি ও এসআই সমীর ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা দুজনের মধ্যে ভাগ করে নেন। অপরদিকে প্রতি কনস্টেবলকে ১৭ লাখ করে দেওয়ার কথা থাকলেও সেই পরিমাণ টাকা না দেওয়ায় পুলিশের অভ্যন্তরে চাপা ক্ষোভ দেখা দেয়। এতে করে ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে কয়েক দফায় জড়িতদের সতর্ক করে বৈঠকে বসেন সংশ্লিষ্টরা।
অস্বীকারের পর স্বীকারোক্তি : প্রথমে অস্বীকার করলেও তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের পর অভিযানে থাকা দুই পুলিশ কনস্টেবল নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরের কাছে সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন। তারা বলেন, অভিযানের সময় হঠাৎ এসআই সমীর গুহ ইয়াবা আত্মসাৎ ও বিক্রির প্রস্তাব দেন। এরপর ওসি জাহাঙ্গীর স্যার ফোনে এসপি স্যারকে ম্যানেজ করে ইয়াবাগুলো বিক্রিতে রাজি করান। এসপি স্যার রাজি হওয়ায় সবকিছু সহজ হয়ে যায়। পরে চুপ থাকার জন্য আমাদের (কনস্টেবলদের) জনপ্রতি ১৭ লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র সাড়ে ৭ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তবে পুরো ঘটনায় আমাদের কোনো দোষ নেই। কারণ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কনস্টেবলদের কোনো ক্ষমতা নেই।
এদিকে বড় ইয়াবা কেলেঙ্কারির বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা পুলিশের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে তারা গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, যদি এ বিষয়ে কখনো তদন্ত হয়, তখন সংশ্লিষ্টদের কাছে বিস্তারিত জানাবেন।
স্বয়ং পুলিশ সুপার বা এসপি ইয়াবা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ায় ভবিষ্যতে সমস্যা হওয়ার কথা চিন্তা করে জড়িতদের মধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তা কক্সবাজার থেকে বদলির জন্য তদবিরও শুরু করেছেন। তারা যুগান্তরকে বলেন, এসপি রহমত উল্লাহ ইতোমধ্যে পুলিশের ভেতরে ইয়াবা বাণিজ্যের বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এসপি রহমত উল্লাহ যোগদান করার পর অন্তত আরও দুটি ইয়াবা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সব ঘটনায় তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত।
এছাড়া পুলিশের অপকর্মের সাক্ষী হওয়ার কারণে কক্সবাজার শহরের একটি বড় অপরাধী চক্রের কাছে পুলিশ জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ সূত্র। সূত্র জানায়, যুবদল ও ছাত্রদলের ব্যানারে ওই অপরাধী চক্রটি হোটেল দখল, অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু নিজেদের অপকর্ম ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
এদিকে জেলা পুলিশের নানা অপকর্ম ধামাচাপা দিতে স্থানীয় সাংবাদিকদের মাসে অন্তত ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে টেকনাফ থেকে মাসে ৬ লাখ এবং রামু থানা ও গর্জনিয়ার ফাঁড়ি থেকে আরও ৪ লাখ টাকা দেওয়া হয় বলে পুলিশের একাধিক সূত্র দাবি করেছে। যদিও টেকনাফ ও চকরিয়া থানার দুই ওসি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
প্রতিবেদককে টাকা দেওয়ার অপচেষ্টা : ইয়াবা আত্মসাৎ, বেচাকেনা, কারবারিদের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া এবং টাকা বণ্টনসহ সব তথ্য উল্লেখ করে বক্তব্য চেয়ে পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়। এ সময় তিনি তাৎক্ষণিক ফোন করে প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই বিষয়টি এখানেই শেষ করেন। এ বিষয়ে ওসি ডিবি জাহাঙ্গীর আলম আপনার সঙ্গে বসবেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী এসআই সমীর গুহ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওসি জাহাঙ্গীর স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করবেন, আপনাকে সম্মানিত করবেন।’
পরে জেলা গোয়েন্দা সংস্থার ওসি জাহাঙ্গীর আলম গত রোববার রাতে স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে ইয়াবা কেলেঙ্কারির দায়সহ সবকিছু অকপটে স্বীকার করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘যেহেতু আপনার কাছে সব তথ্য রয়েছে, আপনি যদি সুযোগ দেন তাহলে এখানে থাকব, না হলে এসপি স্যারকে বলে বদলি হয়ে যাব। ভাই আপনি যেভাবে চান, সেভাবেই সব হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখান থেকে (ইয়াবা কেলেঙ্কারি) আপনাকে একটা বড় সম্মানি দেব এবং সামনে সবকিছুতে আপনাকে আমাদের সঙ্গে রাখা হবে। সবকিছুতে একটা বড় ভাগ আপনার থাকবে।’
ওসি আরও বলেন, ‘মূলত এসআই সমীর গুহের পরিকল্পনায় এই ইয়াবা কেলেঙ্কারির বেচাবিক্রির ঘটনাটি ঘটেছে। তবে টিম লিডার হিসাবে আমি দায় এড়াতে পারি না। নতুন হিসাবে তার অনেক ভুল থাকতে পারে, সেটার জন্য আমি মাফ চাইছি।’ একপর্যায়ে টাকাভর্তি একটি ব্যাগ প্রতিবেদককে ঘুস হিসাবে দেওয়ার জন্য নানারকম চেষ্টা করেন তিনি। ওসি জাহাঙ্গীরের ভাষ্যমতে, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহকে জানিয়ে এবং তার সম্মতিতে তিনি সবকিছু করেছেন।
এদিকে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চেয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশের আইজি এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউ সাড়া দেননি।
তথ্যসূত্র: দৈনিক যুগান্তর
আপনার মতামত জানান