এক মোবাইলেই একশ মাদক কারবারির নাম
সন্তানকে ব্যারিস্টার বানানোর স্বপ্ন নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছিলেন মা-বাবা। ছেলে কৃতিত্বের সঙ্গে ব্যারিস্টারি পাসও করেন। বছর দুই আগে ধনাঢ্য বাবার সেই সন্তান পড়াশোনা শেষ করে ফেরেন দেশে। ছেলের মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করেন মা-বাবা। সব কাজে অনিয়মিত। মেজাজও খিটখিটে। একই ধরনের আচার-ব্যবহার ছেলের স্ত্রীর মধ্যেও দেখতে পান তারা। প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে বিয়ে। ফলে তেমন কোনো আপত্তি ছিল না পরিবারের। এক পর্যায়ে বাবা-মা নিশ্চিত হন- ব্যারিস্টারি পাস করা ছেলে ও তার বউ ইয়াবায় আসক্ত। কূল-কিনারা না দেখে ইয়াবার জোগানদাতাকে চিহ্নিত করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) শরণাপন্ন হয় পরিবার। শুরু হয় তদন্ত। প্রাথমিকভাবে পিবিআই এক মোবাইল নম্বরের (০১৭০৭৯৫৬৩১৩) খোঁজ পায়। ওই নম্বরে নিয়মিত যোগাযোগ করে বিদেশফেরত ব্যারিস্টার ইয়াবা সংগ্রহ করতেন। এর পর বেরিয়ে আসে ইয়াবার জোগানদাতার পূর্ণ পরিচয়। তার নাম মো. আল আমিন। মোহাম্মদপুরের বিজলী মহল্লায় তার বাসা। গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহনে। তার বাবার নাম মৃত আনোয়ার হোসেন।
আল আমিনের সূত্র ধরে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা তদন্তে ১০১ জন ইয়াবা কারবারির নাম বেরিয়ে আসে। ২৫টি জেলায় তাদের নেটওয়ার্ক। ১০১ কারবারির মধ্যে ৪১ জনের সঠিক নাম-ঠিকানা ও পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের আসামি করে গতকাল সোমবার আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পিবিআই। বাদ-বাকিদের ব্যাপারে ছায়া তদন্ত চলবে। পূর্ণ ঠিকানা ও পরিচয় পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
পিবিআই বলছে, কোনো একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে দেড় বছর তদন্ত করে ২৫ জেলায় একই নেটওয়ার্ক থেকে মাদক বাণিজ্যের রুট শনাক্ত করার ঘটনা এই প্রথম। কারণ মাদকের বাহক থেকে শুরু করে পাইকারি বিক্রেতা ও অর্থ লগ্নিকারীরা একে অপরের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ রাখে না। তাই অধিকাংশ সময় বাহক ধরা পড়লেও চক্রের অন্য সদস্যরা শনাক্ত হয় না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পিবিআইপ্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সমকালকে বলেন, মাদকাসক্ত এক যুবকের সূত্র ধরে প্রথমে একজন কারবারিকে শনাক্ত করেছি। এর পর আমরা ধীরে ধীরে এর গভীরে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ভয়ঙ্কর চিত্র। প্রথম যে কারবারিকে পাওয়া গিয়েছিল, তার সঙ্গে স্তরে স্তরে পৃথক ১০১ জন কারবারির যোগাযোগ। যারা এ চক্রে জড়িত তাদের অধিকাংশ সমাজে ভালো পেশায় কর্মরত। ওই পেশার আড়ালে মূলত তারা মাদক কেনাবেচা করে আসছে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, মাদক কেনাবেচায় একটি বড় ক্লু পাওয়ার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে তদন্ত শুরু করে পিবিআই। ২৫ জেলায় মাদক কারবারে সংশ্নিষ্ট পুরো চক্রকে শনাক্ত করে পিবিআইর অর্গানাইজড ক্রাইমের এসআই জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে গত বছরের ১৭ নভেম্বর পল্লবী থানায় মামলা করেন। তদন্তে এত তথ্য উঠে এসেছিল যে, শুধু একটি মামলার এজাহার ছিল ৬ পৃষ্ঠার। তদন্তে উঠে আসে, আসামিরা সংঘবদ্ধভাবে মাদক কারবারে জড়িত। গোপনে তারা মাদক কারবারে অর্থ যোগান দিয়ে আসছে। দেশে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে মিয়ানমার ও ভারত থেকে তারা মাদক আমদানি করত।
২৫ জেলায় একই চক্র: আল আমিনের কাছ থেকে নিয়মিত ইয়াবা কিনত ১১ জন। ওই ১১ জনসহ একই সিন্ডিকেটে ২৫ জেলায় ১০১ জন কারবারি রয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকা জেলার কারবারি ৪৮ জন, কুষ্টিয়ার ৯, টাঙ্গাইলের ২, ভোলার ৪, নীলফামারীর ২. কক্সবাজারের ২, নারায়ণগঞ্জের ২, কিশোরগঞ্জ ও চাঁদপুরের ২ জন। এই চক্রে একজন করে যেসব জেলার মাদক কারবারি রয়েছে সেসব জেলা হলো- যশোর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, চুয়াডাঙ্গা, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও ব্রা?হ্মণবাড়িয়া। জাতীয় পরিচয়পত্রে রহস্যজনক কারণে ৯ জন কারবারির কোনো ঠিকানা মেলেনি। কীভাবে স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানা ছাড়াই তারা জাতীয় পরিচয়পত্র পেল- এটা দেখে বিস্মিত তদন্ত সংশ্নিষ্টরাও।
১০১ জনের তালিকা: শুধু ০১৭০৭৯৫৬৩১৩ নম্বরের সূত্র ধরে যে ১০১ জন মাদক কারবারিকে শনাক্ত করা হয়েছে, তারা হলো- মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ৭ নম্বর সড়কের ১৩৪ নম্বর বাসার শামসুল আলম ইমন। ০১৭১০৯১২৬৭৮ ও ০১৮৮১৯২৫৯৪০- এ দুটি নম্বর থেকে মাদক কেনাবেচা সংক্রান্ত কথোপকথন চালাত ইমন। তালিকায় আছে- মোহাম্মদপুরের টিক্কাপাড়ার আমিনুল ইসলাম মিন্টু (০১৯১৫৫৭৩৭৮১), মিরপুর-১ নম্বরের কলওয়ালাপাড়ার মেহেদী শাহীন, মোহাম্মদপুরের জহুরী মহল্লার মো. নাজিম, কাটাশুরের তানভীর আহমেদ রনি, মাগুরা সদরের নতুন বাজার সাহাপাড়ার সজীব কুমার ঘোষ, কুষ্টিয়ার খোকসার মো. শাহজাহান বাদশা ওরফে লালু, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের সরওয়ার জাহান সোহাগ (০১৭৫৬০৪৭২১৮), বিক্রমপুরের দানিয়াল আবেদীন, ভোলা সদরের কালুপুরের মো. নুরুন্নবী, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের নাজমা আখতার আঁখি, ঢাকার উত্তরার ইফফাত জাহান, শামসুন্নাহার, সিদ্দিকুর রহমান, মোহাম্মদ হোসাইন, আরমান হোসাইন, সাবিক উদ্দীন আহমেদ তাসিন, আয়েশা বেগম নাইম, নাইমুজ্জামান নাদিম, রাবেয়া বেগম, ইউসুফ আলী, হামিদ হেসাইন, আবদুস সালাম, মশিউর রহমান, আবু হোসাইন জনি, বিকাশা আক্তার ওরফে বিকে রাব্বি, মো. নওশাদ, পারভীন, আলী আকবর, রাশেদ, জান্নাতুল ফেরদৌসি, হাসিন ইশরাক, শ্রাবণ আহমেদ পাভেল, লাইলী, বিপুল চন্দ্র দাস, সন্তোষ কুমার পাল, জাকির হোসেন, হাছিনা, জহিরুল ইসলাম, মোবারক হোসাইন, আল আমিন, ভানু, জুয়েল, শিরিনা খাতুন, আরমান ফেরদৌসি, উম্মে তাজনীন আফসারি, রাকিব হাসান, আমেনা আক্তার মিতু, নাহিদা আক্তার, রুমানা আক্তার, রেজাউল করিম, মাসুদ রানা, জহিরুল ইসলাম রিপন, শিপন, রহিমা, মো. রাসেল সরদার, ইউসুফ হারুন, জুয়েল, করিম খান, অনিক শিকদার, রফিকুল ইসলাম, বাবু, কামাল হোসাইন শান্ত, সেলিম, আবদুল আজিজ, মুরাদ, শামীম আহমেদ, জব্বার সর্দার, অরুণ হাওলাদার, আলী মুকুল, পরশ মনি, ফায়েজান আহমেদ, রায়হান, রাবেয়া বেগম, হান্নান মৃধা, আমিন, নুরুল, অজুফা বেগ, এসএম রবিউল ইসলাম আকাশ, তাসলিমা খাতুন, সফিকুল ইসলাম টোকন, খোকন শেখ, আবদুল বারেক মল্লিক, হিলাল খান, ইউসুফ আলী, গোলাপী খাতুন, জাফর শেখ, আসাদুর রহমান, কামরুল হাসান, ইমরান মণ্ডল, সাবিনা খাতুন, রবিউল শেখ, মাহবুব মজিদ, বিপ্লব খান, ইব্রাহিম, রফিকুল ইসলাম রনি ও ইকবাল তালুকদার।
আপনার মতামত জানান