আল্লাহভীতি যেভাবে ভালো কাজের আগ্রহ বাড়ায়
আরবি তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ বেঁচে থাকা, বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় তাকওয়া হলো আল্লাহকে সদা উপস্থিত ও সর্বদ্রষ্টা জ্ঞান করে ভালো ও মন্দ কাজের পার্থক্য মেনে চলা, মন্দ কাজ পরিহার করে ভালো কাজে আত্মনিয়োগ করা। অন্যভাবে বললে, তাকওয়া বা আল্লাহভীতি হলো অন্তরের এমন অনুভূতির নাম, যার ভিত্তিতে যেকোনো কাজ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী করার গভীর আগ্রহ তৈরি হয় এবং আল্লাহর অবাধ্যতার ব্যাপারে ঘৃণা সৃষ্টি হয়। পবিত্র কোরআনের হজবিষয়ক একটি আয়াত থেকে এমন ধারণাই লাভ করা যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘এটাই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করলে এটা তার হৃদয়ের তাকওয়া সঞ্জাত।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩২)
ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করবে; নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন।’
(সুরা : তাওবা, আয়াত : ৪)
ভালো কাজও আল্লাহভীতির অংশ : উল্লিখিত আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে আল্লাহভীতি প্রধানত অন্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তা পাপ কাজ থেকে বাঁচার মতো ইতিবাচক কাজে লিপ্ত হওয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক রাখে। কেননা আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অন্তরের একটি ইতিবাচক প্রক্রিয়া। অন্য এক আয়াতেও অন্তরকে আল্লাহভীতির কেন্দ্র বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর রাসুলের সম্মুখে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তর তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৩)
পাপ ও পুণ্য উভয়ের উৎস অন্তর : শুধু আল্লাহভীতি নয়, বরং মানুষের পাপচিন্তার উদয়স্থলও অন্তর। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তাকে তার অন্তরে অসৎকর্ম ও তার সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে-ই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে, সে-ই ব্যর্থ, যে নিজেকে কলুষিত করেছে।’ (সুরা : শামস, আয়াত : ৮-১০)
কাজে-কর্মে প্রকাশ পায় আল্লাহভীতি : তাকওয়া দ্বারা যেমন অন্তরের অবস্থা বোঝায়, তেমনি তাঁর বাহ্যিক প্রক্রিয়াকেও বোঝায়। অবিশ্বাসীদের চূর্ণবিচূর্ণ করার ক্ষমতা এবং প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ থাকার পরও সাহাবায়ে কিরাম হুদায়বিয়ার সন্ধি মেনে নিয়েছিলেন। আল্লাহ এই ঘটনাকে তাকওয়ার সৌন্দর্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন অবিশ্বাসীরা তাদের অন্তরে পোষণ করত গোত্রীয় অহমিকা—অজ্ঞতা যুগের অহমিকা, তখন আল্লাহ তাঁর রাসুল ও মুমিনদের স্বীয় প্রশান্তি দান করলেন আর তাদের তাকওয়ার বাক্যে সুদৃঢ় করলেন এবং তারাই ছিল তার অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখেন।’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ২৬)
এ আয়াতে যুদ্ধবিগ্রহ পরিহার, কাবাঘরের প্রতি সম্মান এবং কুরাইশের মূর্খতাসুলভ আচরণ উপেক্ষা করাকে তাকওয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা অঙ্গীকার পূরণ ও যথাসম্ভব যুদ্ধ পরিহারকারীদের আল্লাহভীরু আখ্যা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করবে; নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৪)
আল্লাহভীতি ভালো কাজের আগ্রহ বাড়ায় : পাপ কাজ, মন্দ শিক্ষা, মন্দ সংস্রব যেভাবে মানুষের ভেতর মন্দপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলে, তেমনি আল্লাহভীতি মানুষের ভেতর ভালো কাজের আগ্রহ বৃদ্ধি করে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা সৎপথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং তাদের মুত্তাকি হওয়ার শক্তি দান করেন।’ (সুরা : মুহাম্মদ, আয়াত : ১৭)
আল্লাহভীতিই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি : ইসলাম মানবসমাজ থেকে বংশ, বর্ণ, স্থান, সম্পদসহ সামাজিক মর্যাদার সব মাপকাঠিকে অস্বীকার করে শুধু একটি বিষয়কে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসেবে উল্লেখ করেছে। তা হলো আল্লাহভীতি। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদের বিভিন্ন শ্রেণি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা নিজেদের চিনতে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত, যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
ইসলামী শিক্ষার প্রাণসত্তা আল্লাহভীতি : আল্লামা আশরাফ আলী থানবি (রহ.) কোরআনের তাকওয়া বা আল্লাহভীতি বিষয়ক আয়াতগুলো একত্র করে বলেছেন, এসব আয়াত থেকে বোঝা যায় কোরআনের বিধি-বিধান ও শিক্ষার প্রাণসত্তা হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।
সূত্রঃ মাওলানা আবদুল্লাহ আব্বাস নদভি, কালেরকণ্ঠ।
আপনার মতামত জানান