আপন আলোয় উদ্ভাসিত বঙ্গমাতা
ডা. নুজহাত চৌধুরী
টুঙ্গিপাড়ার রেণু থেকে বাংলাদেশের কোটি জনতার বঙ্গমাতা হওয়ার যাত্রাটা সহজ ছিল না বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের। জাতির এই মাতৃরূপে সম্মানীয় হওয়ার স্থানটি তাঁকে অর্জন করতে হয়েছে বহু কষ্ট ও ত্যাগে। নিজের ধৈর্য, সহ্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে জীবনের কঠিন সময়ে, নিজ যোগ্যতার স্ফুরণ ঘটিয়ে তিনি অর্জন করেছেন এই সম্মান। নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে, সন্তানদের ভবিষ্যেক অনিশ্চিত করে, সব প্রলোভনে নির্লোভ থেকে, আদর্শে অবিচল থেকেছেন বলেই তিনি ‘বঙ্গমাতা‘। শুধু নেতার স্ত্রী বলে নয়, ইতিহাসের কিছু জটিল সময়ে নিজ প্রজ্ঞা ও সাহস দিয়ে তিনি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন বলেই আজ তিনি ‘বঙ্গমাতা‘ হিসেবে বরণীয় ও স্মরণীয়। এই বিষয়টি আমাদের সম্যকভাবে বুঝতে ও ইতিহাসটি জানতে হবে। না হলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের আনুষ্ঠানিকতাই থেকে যাবে।
আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের কিছু সংকটময় সময়ে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, যা রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের বাঁক পরিবর্তন করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে সহায়তা করে। নীরবে, দৃষ্টির অগোচরে রাখা তাঁর কিছু দৃঢ় সিদ্ধান্ত জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রেখেছে স্পষ্ট অবদান। কিছুটা অগোচরেই থেকে গেছে তাঁর সেই অবদান। কিন্তু ইতিহাস গভীরভাবে পাঠ করলে জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিকালে তাঁর সেই অবদানগুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অনুধাবন করা যায় যে বঙ্গমাতা আমাদের ইতিহাসে নিজ যোগ্যতা ও অর্জন দিয়েই আপন আলোয় উদ্ভাসিত এক মহীয়সী নারী।
১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১ নম্বর আসামি করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক ডেকে তাতে বঙ্গবন্ধুকে যোগদানের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে রাজি হলেন। কিন্তু বেগম মুজিব রাজি হননি। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেন, কোনো ধরনের আপস তিনি মেনে নেবেন না। এবং শুধু বঙ্গবন্ধুর একা বের হয়ে আসার ব্যাপারেও তাঁর আপত্তি ছিল। কী অসাধারণ নারী! নিজের লাভ, নিজের সুবিধাকে কী অনায়াসে তুচ্ছ করে, কী দৃঢ়তার সঙ্গে বৃহত্তর অর্জনকে অনুধাবন করতে পারতেন এবং সেই সিদ্ধান্ত সব প্রতিরোধের মুখেও কী দৃঢ়তার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে পারতেন!
তাঁর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তিতে অসম্মতি জানান। পরে প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে। বঙ্গবন্ধু অন্য সব অভিযুক্তকে সঙ্গে নিয়ে বিজয়ীর বেশে বেরিয়ে আসেন কারাগার থেকে। আর তখন থেকেই ‘মুজিব ভাই’ পরিণত হন জাতির অবিসংবাদিত নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’তে। বঙ্গবন্ধুর এই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে বেগম মুজিবের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। সবাই অনুধাবন করেন আমাদের ইতিহাসে এক ক্রান্তিলগ্নে কী গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা বেগম মুজিব রেখেছেন মঞ্চের নেপথ্যে থেকে, নীরবে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা ও চারিত্র্যের দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়।
একই রকম নেপথ্যে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে আমরা দেখি ৭ই মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণের আগে। এ ক্ষেত্রে তাঁর অল্প দু-একটি কথার প্রভাব বোঝার জন্য সেই সময়ের বহুবিধ সংকট ও টানাপড়েনকে বুঝতে হবে। সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়ার তকমা পরিহার করার চেষ্টা, দলের মানুষের বহুমুখী চাপ, জনগণের নিরাপত্তা সব কিছুই সেই সিদ্ধান্তের অনুঘটক ছিল। বিভিন্নজন বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিন অনেক জ্বর। সারা দেশ, সারা বিশ্ব ও হিংস্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকিয়ে আছে তাঁর প্রতিটি বাক্যের দিকে। এ সময় বেগম মুজিব তাঁকে আলাদা করে নিয়ে বললেন, কারো কথা না শুনে, যে মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু সারা জীবন রাজনীতি করেছেন, শুধু তাদের কথা ভেবে নিজের মন যা বলে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে। এরপরের সব ইতিহাস তো স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। সেই কালজয়ী ভাষণ, অনন্যসাধারণ কৌশল আর দিকনির্দেশনার সেই স্বাধীনতার আহ্বান। কোনো লিখিত কাগজ নেই, হৃদয় থেকে উৎসারিত কথাগুচ্ছ— অবিসংবাদিত এক নেতার থেকে তাঁর বীর জনগণের প্রতি। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গেল। পেছনে নীরবে ছিল সেই মহীয়সী নারীর শান্ত, দৃঢ়, সত্য কয়েকটি উচ্চারণ।
বেগম মুজিবের এই প্রজ্ঞা, সঠিক সময়ে দৃঢ় সঠিক পরামর্শ বঙ্গবন্ধুকে বারবার সাহায্য করেছে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে। দেশের মানুষের প্রতি বেগম মুজিবের ভালোবাসা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তাদের নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার ওপরে স্থান দেওয়ার নির্লোভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তাঁকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং তাতে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকতে সাহায্য করেছে। আর এই ভালোবাসা, ত্যাগ ও অবদানই তাঁকে পরিণত করেছে আমাদের কাছে ‘বঙ্গমাতায়’। এই অবস্থান তাঁর নিজের অর্জন। এই সম্মান তাঁর নিজের কর্ম ও ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে অর্জিত।
এই সম্মান শুধু দেশবাসীর চোখে নয়, তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছেও তিনি অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর লেখায় যেখানেই তাঁর রেণুর প্রসঙ্গ এসেছে, সেখানেই প্রতি বাক্যে প্রগাঢ় ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে এক গভীর শ্রদ্ধাবোধের চিত্র খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। নিজের জীবনে শুধু নয়, জাতির ক্রান্তিকালেও বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বকেও দেখতে পাই অনেক ক্ষেত্রেই বেগম মুজিবের অনুরোধ বা সিদ্ধান্তকে সঠিক গণ্য করে গ্রহণ করছেন। এগুলো বেগম মুজিবের মেধা ও প্রজ্ঞার বিশ্বাস ও অর্জিত শ্রদ্ধার পরিচায়ক। বঙ্গবন্ধু নিজেও তা স্বীকার করেছেন, যা আমরা তাঁর বিভিন্ন লেখায় পাই। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’ জাতি হিসেবে আমাদেরও বঙ্গমাতার কাছে ঋণ স্বীকার করা প্রয়োজন।
আজ আমরা বঙ্গবন্ধুর লেখা যে বইগুলো পড়ে আমাদের জাতির পিতাকে চিনি, আমাদের জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে অবিকৃত বর্ণনা পড়ি, সেই বইগুলো বঙ্গবন্ধুর লেখা ডায়েরি। এই ডায়েরি লেখার চিন্তাটিও বঙ্গমাতার। জেলখানায় নিজে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন ডায়েরি, বলেছিলেন স্মৃতিগুলো ধারণ করে রাখার জন্য। ডকুমেন্টেশন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমরা কয়জন উপলব্ধি করি? অথচ বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা যে একটি জাতির ইতিহাসের জন্য লিখে রাখা খুব প্রয়োজন, তা সেই গৃহবধূ ঠিকই বুঝেছিলেন। এটা তাঁর সহজাত প্রজ্ঞার পরিচয়। শুধু তা-ই নয়, সেই ডায়েরিগুলোকে যত্ন করে তুলে রাখা এবং সেই যুদ্ধকালীন পাকিস্তানিদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে ডায়েরিগুলোকে টিকিয়ে রাখার কৃতিত্বও তাঁর। ১৯৭৫-এর বিভীষিকার পর সেই ডায়েরি উদ্ধার করে, বহু বছরের বহু পরিশ্রমের পর সেগুলো আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার যে রোমাঞ্চকর যাত্রা, সেই কৃতিত্ব বঙ্গমাতার যোগ্য উত্তরসূরি তাঁর বড় কন্যা শেখ হাসিনার। আমাদের জাতির প্রকৃত ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা তাঁর ডায়েরিগুলো আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে অবিকৃত সত্য উপস্থাপন। যে ইতিহাস ছিল বিস্মৃতির গহ্বরে, তাকে এমন অবিকৃতভাবে লিপিবদ্ধ রাখার বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা বঙ্গমাতা বেগম মুজিবের। ইতিহাসে এ অমূল্য উপহার জাতিকে দেওয়ার জন্যও এই জাতির তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
আজও তাঁর কন্যারা প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিয়ে তাঁদের মায়ের স্মৃতিচারণা করেন। ব্যক্তিগত কথোপকথনে তাঁদের বেড়ে ওঠায় মায়ের বেশি অবদানের কথা তাঁরা নির্দ্বিধায় বলেন। বলেন, মাকেই ভয় পেতেন বেশি। বাবা তো জেলেই ছিলেন বেশির ভাগ সময়। অথচ এই যে আজ বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা এক হাতে টেনে নিয়ে তুলছেন এই দেশকে উন্নয়নের সিঁড়িতে, এই ব্যক্তিত্ব গড়ে দিয়েছেন সেই মহীয়সী মা। বাবার রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিতভাবে অনস্বীকার্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে, জেল-জুলুম-হুলিয়াসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পাঁচটি সন্তানকে শুধু পড়াশোনা করানো নয়, সুচারিত্র্যে গড়ে তোলা, সংস্কৃতিমনস্ক করে তোলা সহজ ছিল না। অথচ বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন, ‘অনেক সময় আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি না আমার ছেলে-মেয়ের কাছে।’ যেকোনো মানুষই অনুধাবন করবেন পাঁচ সন্তানের সংসার চালিয়ে নিতে তবে কতটা বেগ পেতে হয়েছে এই মহীয়সী নারীকে। অথচ তিনি কখনো প্রতিবাদ তো করেনইনি; বরং ইতিহাসের বাঁকে আমরা দেখেছি, যখন আপসের সুযোগ এসেছে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সেগুলো ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরা অনেকেই জানি না, ছোট মেয়ে শেখ রেহানা মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। শেখ কামাল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি সেতার বাজাতেন, খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন, ছিলেন মঞ্চাভিনেতাও। এই সন্তানরা সেই রত্নগর্ভা মায়ের কৃতিত্বের স্বাক্ষর।
আজ কিছু নেতার স্ত্রী, পরিবার-পরিজনকে দেখি। তাদের বেশ, ভূষণ, আবাসন—সবই দৃশ্যমান। নেতাদের ক্ষমতার শক্তির চেয়ে তাঁদের পরিবার-পরিজনের ক্ষমতার দাপটকে জনগণ অনেক বেশি ভয় পায়। সত্য তেতো; কিন্তু এটাই সত্য। আজ রেণুর অনেক প্রয়োজন অনুভব করি। তাঁর উদাহরণ থেকে শুধু তাঁর কন্যারাই শিখলেন, আমরা কিছু শিখলাম না—এটাই আফসোস। আমাদের এই মহীয়সী নারীর জীবনী পাঠ করা প্রয়োজন, জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন—কিভাবে নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে হয়, আদর্শের জন্য ত্যাগ করতে হয়, নেতার যোগ্য সহধর্মিণী কেমন হতে হয়। তাহলেই হয়তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপণন থেকে বের হয়ে এসে সত্যি সত্যি দেশের সেবক রাজনীতিবিদ হতে পারবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিনে সেটাই আমার প্রত্যাশা। বঙ্গমাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তি কামনা করি।
লেখক : অধ্যাপক (চক্ষু), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
সুত্র: কালের কন্ঠ
আপনার মতামত জানান