রমজানে অথই জলরাশির দেশ মালদ্বীপ
স্বচ্ছ বিস্তীর্ণ নীলাভ জলরাশির বুকে জেগে থাকা শ্বেতশুভ্র বালুকা। তার ওপর আল্লাহর দরবারে নত হয়ে হেলেদুলে জিকিরে মগ্ন থাকা সারি সারি নারকেলগাছ। বলছিলাম সহস্রাধিক প্রবালদ্বীপের প্রাকৃতিক লীলাভূমি শতভাগ মুসলমানের দেশ মালদ্বীপের কথা।
শ্রীলঙ্কা থেকে আনুমানিক ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণের এই দ্বীপপুঞ্জ দেশের রাজধানী মালে। জনসংখ্যা তিন লাখ ৯২ হাজার ৪৭৩। আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার।
১২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই দ্বীপে কোনো মুসলমান ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২০০ খ্রিস্টাব্দে আবুল বারাকাত নামের এক মরক্কান (ভিন্ন মতে, পারস্যের তাবরিজের অধিবাসী) মালদ্বীপে এসেছিলেন। তিনি মালদ্বীপের রাজাকে দাওয়াত দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করালে একসময় দ্বীপের সব মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
প্রখ্যাত মুসলিম পর্যটক ও ইতিহাসবিদ ইবনে বতুতা (রহ.) ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে মালদ্বীপের ওই ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন, ভ্রমণ করতে করতে তিনি যখন মালদ্বীপে পৌঁছলেন, তখন মালদ্বীপকে পেয়েছিলেন ইসলামের উর্বর ভূমি হিসেবে। সেখানকার প্রতিটি শহর-নগর মুখরিত ছিল আজানের মধুময় ধ্বনিতে। মহান আল্লাহর সিজদায় মগ্ন মালদ্বীপের বাসিন্দারা। এ অবস্থা দেখে ইবনে বতুতা খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ তাঁর জানা মতে, কোনো ইসলাম প্রচারক মালদ্বীপে আসেননি। তাহলে এভাবে ইসলামের সবুজ কাননে এই ভূমি কে সাজিয়েছে?
অবশেষে অনুসন্ধান চালিয়ে তিনি জানতে পারেন, অনেক দিন আগে আরবের কোনো এক বাণিজ্য জাহাজ তুমুল ঝড়ের কবলে পড়ে। সেই ঝড়ে জাহাজের অভিযাত্রী সবাই মারা যায়। সেই কাফেলার একজন মাত্র লোক কোনোমতে একটি কাঠের টুকরা অবলম্বন করে আশ্রয় নেন এই দ্বীপে। তিনিই সেই হাফেজ আবুল বারাকাত, যাঁর ঈমানের কষ্টিপাথরের স্পর্শে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন মালদ্বীপের সমুদ্র-সুলতান খ্যাত তৎকালীন বাদশাহ। এরপর দলে দলে মালদ্বীপবাসী আশ্রয় নিতে থাকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায়।
সেই শীতল ইসলামের হাওয়া আজও বহমান মালদ্বীপজুড়ে। আজও মালদ্বীপের অলিগলি মুখরিত থাকে আজানের সুমধুর সুরে। মসজিদগুলো কানায় কানায় ভরে যায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লির ভিড়ে।
পবিত্র রমজানে মালদ্বীপে লক্ষ করা যায় বাড়তি আমেজ। রমজানে এখানে জনগণের কাজের চাপ কমিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন মোবাইল কম্পানি থেকে দেওয়া হয় বিশেষ রমজান অফার। হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে দেওয়া হয় রমজানের বিশেষ ছাড়। পর্যটননির্ভর দেশ হয়েও রমজানে দিনের বেলায় এখানে প্রকাশ্যে কোনো খাবার খাওয়ার অবকাশ নেই। তবে অমুসলিম পর্যটক কিংবা সংখ্যালঘু অধিবাসী চাইলে নিজেদের ঘরে বা হোটেলে খাবার গ্রহণ করতে পারে। পবিত্র রমজান উপলক্ষে সেখানকার হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে থাকে নান্দনিক ইফতারের আয়োজন। দেশি-বিদেশি হরেক ইফতার যে কাউকে আকর্ষণ করবে। বড় বড় মসজিদে প্রতিদিনই থাকে ইফতারের আয়োজন। ইফতারের পূর্বমুহূর্তে ধনী-গরিব সবাই বসে একসঙ্গে হাত তোলে মহান আল্লাহর দরবারে। ইফতারের সময় হলেই সেখানে আসা মুসল্লিদের জন্য বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয় খেজুর, বিভিন্ন ফলের জুস ও নানা দেশীয় ইফতার।
মালদ্বীপে দেশীয় ইফতার হিসেবে পরিচিত খাবারগুলো হলো বোকিবা (ফুডিংয়ের মতো দেখতে এক ধরনের মিষ্টি খাবার), বাজিয়া (সমুসার মতো দেখতে), গুলহা (অনেকটা লাড্ডুর মতো দেখতে), মাশরোশি (দেখতে অনেকটা বাখরখানির মতো, তবে এটি বানানো হয় নারকেল দিয়ে)। এ ছাড়া মাছ ও মাংসের হরেক ইফতার তো আছেই।
রমজানে সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে।
এককথায়, পবিত্র রমজান উপলক্ষে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে মালদ্বীপজুড়ে।
আপনার মতামত জানান