মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে হাসানি নদভি (রহ.) এর বিদায়

প্রকাশিত


ড. মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন
চলে গেলেন ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ষীয়ান আলেম ও বিশ্বনন্দিত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভির সুযোগ্য উত্তরসূরি সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে হাসানি নদভি (রহ.)। গত ২১ রমজান রোজ বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল ২০২৩) জোহরের সময় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বভাবজাত বিনম্র, জ্ঞানের ভারে ন্যুব্জ, আকার-আকৃতি ও বেশভূষায় দেখতে তিনি অনেকটা আপন মামা আল্লামা আবুল হাসান আলী মিয়া নদভি (রহ.)-এর মতোই ছিলেন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মামার ইন্তিকালের পর এ যোগ্য ভাগ্নেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের অন্যতম অভিভাবক।

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই ইসলামী ব্যক্তিত্ব দেশ-বিদেশের বহু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি একাধারে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের বর্তমান সভাপতি, দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার বর্তমান রেক্টর, রিয়াদস্থ রাবেতাতুল আদাব আল-ইসলামীর সভাপতি এবং মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। একইভাবে তিনি লখনউস্থ মজলিসে তাহকিকাত ও নশারিয়তে ইসলাম, উত্তরপ্রদেশের দ্বিনি তালিমি কাউন্সিল, রায়বেরেলির দারে আরাফাত, মাওলানা আবদুল বারি নদভি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়স্থ সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজ এবং আজমগড়ে অবস্থিত দারুল মুসান্নিফের সদস্য, পয়ামে ইনসানিয়াত ও ইসলামী ফিকহ একাডেমি ভারতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ ছাড়া মাওলানা আবুল কালাম আজাদ একাডেমি লখনউ, দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরা, আলীগড় ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়ের উপদেষ্টা পরিষদ, দারুল উলুম বস্তির মজলিসে শুরা, আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভি একাডেমি, ভটকলেরও সদস্য। একইভাবে তিনি ভারত ও ভারতের বাইরে অবস্থিত বেশ কিছু ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দ্বিনি মাদরাসার পৃষ্ঠপোষক ও উপদেষ্টা ছিলেন।


শায়েখ রাবে হাসানি নদভি (রহ.)-এর জন্ম ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর ভারতের উত্তরপ্রদেশের রাইবেরেলিতে। পিতা রশিদ আহমদ ইবনে খলিলুদ্দিন হাসানি। পুরো নাম মুহাম্মদ আর-রাবে। তাঁর পরিবার অভিজাত হাসানি বংশোদ্ভূত, যাঁদের পূর্বপুরুষ হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরব থেকে ভারতের উত্তরাঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন। অতঃপর মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীরের (মৃত্যু ১১১৮ হি.) আমলে রাইবেরেলিতে থিতু হন।

পারিবারিকভাবে জ্ঞান ও ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন শায়খ মুহাম্মদ রাবে। তাঁর মা ছিলেন আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভির সহোদরা এবং যুগের মহীয়সী নারী আল্লামা নদভির মা খায়রুন্নেসার মেয়ে। ফলে শায়খ রাবে যুগশ্রেষ্ঠ জননী ও নানির একান্ত তরবিয়ত হাসিলের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁদের হাতেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি। প্রাথমিক শিক্ষার পর লখনউ চলে আসেন দুই মামা ডা. আবদুল আলী হাসানি ও আবুল হাসানী নদভি (রহ.)-এর সান্নিধ্যে। বিশেষত তিনি শায়খ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)-এর শিষ্যত্ব লাভ করেন। তাঁর কাছে ভাষা, সাহিত্য ও ইসলামী শরিয়তের বেশ কিছু কিতাব পড়েন। তারপর ভর্তি হন দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় এবং পুরোদমে উপকৃত হন সেখানকার প্রসিদ্ধ শিক্ষাগুরুদের মাধ্যমে। অবশেষে ১৯৪৮ সালে নদওয়া থেকে ফারেগ হন। শিক্ষার পাশাপাশি তিনি আধ্যাত্মিক দীক্ষাও লাভ করেন যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গদের কাছে। যেমন মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরি (রহ.), শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া (রহ.) ও শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) প্রমুখ।

১৯৪৯ সালে তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক নিযুক্ত হন। তখন আল্লামা আবুল হাসান নদভির ঐতিহাসিক সফরে সঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয় তার। ১৯৫০ সালে হেজাজ তথা পবিত্র মক্কা-মদিনা সফর করেন। এর মধ্যে এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত করেন দাওয়াতের ক্ষেত্রে। যুগের সেরা ইলমি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিত্বদের সাহচর্যে থেকে নিজের অধ্যাত্মিক জীবনকে শাণিত করেন এবং জ্ঞানের নানা উৎস থেকে সরাসরি উপকৃত হন। অতঃপর ফিরে আসেন দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় এবং একাডেমিক বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন হন। এরপর যথাক্রমে ১৯৫২ সালে আরবি সাহিত্যের ওস্তাদ, ১৯৫৫ সালে আরবি সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান, ১৯৭০ সালে আরবি ভাষা ও সাহিত্য অনুষদের ডিন নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে নদওয়াতুল উলামাস্থ দারুল উলুমের মহাপরিচালক শায়খ মুহিব্বুল্লাহ লারি নদভি (রহ.)-এর মৃত্যু হলে শায়খ রাবে হাসানিকে দারুল উলুমের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এদিকে তিনি দারুল উলুমের মূল প্রতিষ্ঠান নদওয়াতুল উলামার সহসভাপতি নিযুক্ত হন ১৯৯৮ সালে। আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর ২০০০ সালের ৩ জানুয়ারি নদওয়াতুল উলামার সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে মাওলানা মুজাহিদুল ইসলামের ইন্তেকাল হলে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সভাপতিও নিযুক্ত হন ২০০৩ সালে।


উপমহাদেশের সাংবাদিকতা জগতে শায়খ মুহাম্মদ রাবে হাসানির ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। শায়খ মুহাম্মদ রাবে (রহ.) ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পাক্ষিক আরবি পত্রিকা ‘আর-রায়িদ’, যা এখনো নদওয়াতুল উলামা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। পাশাপাশি নিয়মিত লিখেছেন অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়ও। বিশেষত মাওলানা মুহাম্মদ আল-হাসানি প্রতিষ্ঠিত আরবি পত্রিকা আল-বাসুল ইসলামীতে। এ ছাড়া তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নদওয়াতুল উলামা থেকে আরো কয়েকটি পত্রিকা বের হয়। যেমন উর্দু ‘তামিরে হায়াত’, হিন্দিতে ‘সাচ্চা রাহি’ এবং ইংরেজিতে পত্রিকা ‘দ্য ফ্রেগ্রেন্স অব ইস্ট’ (The Fragrance of East)।

শায়খ রাবে হাসানি দেশ-বিদেশে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও মহাসম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে প্রদত্ত তাঁর বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইতোমধ্যে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের প্রসিদ্ধ সব ম্যাগাজিন, সাময়িকী ও গবেষণা পত্রিকায়। এ উপলক্ষে তিনি পৃথিবীর অনেক ঐতিহাসিক শহর ও দেশ সফর করেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরব, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, তুরস্ক, মিসর, ইয়েমেন, কুয়েত, আরব আমিরাত, জর্দান, সিরিয়া, লেবানন, ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, মালয়েশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব স্থানে তিনি শুধু পর্যটক হিসেবে নয়; বরং সেখানে তিনি চষে বেড়িয়েছেন সত্যের অনুসন্ধানী পরিব্রাজক হিসেবে। একজন দরদী মালির মতো খোঁজ নিয়েছেন ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের। পরিদর্শন করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইসলামী বিদ্যাপীঠ। অংশ নিয়েছেন সেখানকার বিভিন্ন ইলমি ও সাহিত্য সেমিনারে।

শায়খ রাবে (রহ.) আজীবন লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। মাতৃভাষা উর্দু ও আরবি ভাষায় তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় লিখিত তাঁর গ্রন্থগুলো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি রচনা হলো : ১. কিমাতুল উম্মাতিল ইসলামিয়্যাতু ওয়া মুনযাজাতুহা, ২. মাকালাতুন ফিত তারবিয়াতি ওয়াত তালিম, ৩. আল-আদাবুল আরবি বায়না আরদিন ওয়া নাকদ, ৪. তারিখুল আদব আল-আরবি, ৫. মানসুরাতুন মিন আদাবিল আরব ইত্যাদি। ৬. আল-আদাবুল ইসলামী ওয়া সিলাতুহু বিল হায়াত (আরবি), ৭. আল-আদাবুল ইসলামী, ফিকরাতুহু ওয়া মিনহাজুহু (আরবি), ৮. রাসায়িলুল আলাম (আরবি), ৯. মুআল্লামুল ইনশা, তৃতীয় খণ্ড (আরবি ও উর্দু), ১০. মুখতারুশ শির, দ্বিতীয় খণ্ড (আরবি), ১১. আদওয়াউন আলাল আদাবিল ইসলামী (আরবি, উর্দু), ১২. আল-আলামুল ইসলামী, কাদায়া ওয়া হুলুল (আরবি), ১৩. ফি জিলালিস সিরাতি আন-নববিয়্যাহ (আরবি, উর্দু), ১৪. আদওয়াউন আলাল ফিকহিল ইসলামী (আরবি), ১৫. রিসালাতুল মুনাসাবাত আল-ইসলামিয়্যাহ (আরবি) ইত্যাদি।

আরবি ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শায়খ রাবে (রহ.) ১৯৮২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, আরবি সাহিত্যে ভারতীয় কাউন্সিল উত্তরপ্রদেশ পুরস্কার, রামপুর মাকতাবাতু রেজা সম্মাননা ও পদক লাভে করেন। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে শায়খ রাবে হাসানি নদভির অবদানের ওপর বেশ কিছু গবেষণাকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। ২০১১ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যা এফ এম সুলায়মান পিএইচডি গবেষণা করেন, যে অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল- Indian contributions to Arabic literature a study on Mohd Rabe Hasani Nadwi। ২০১২ সালে গৌহাটি (বর্তমানে গুয়াহাটি) বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক আহমদ মোবারক পিএইচডি গবেষণা করেন যে অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল- A study on Arabic prose writers in India with special reference to Maulana Muhammad Rabey Hasani Nadwi।

শায়খ মুহাম্মদ রাবে হাসানির মৃত্যু মুসলিম বিশ্বের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর ইন্তিকালে ইসলামী সাহিত্যমহলে যেমন শোকের ছায়া নেমে এসেছে, তেমনি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা হারিয়েছে একজন যোগ্য ও দরদী অভিভাবক। মহান আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন এবং ইসলাম ও উম্মাহর জন্য নিবেদিত তাঁর সব খেদমত কবুল করুন। তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।

আপনার মতামত জানান