আইভী নিজেই একটা প্রতীক

প্রকাশিত

প্রথম আলোর সোনারগাঁ প্রতিনিধি, মনিরুজ্জামান এর ফেসবুক পোষ্ট

নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন মানেই দারুণ সব নাটকীয়তা আর উত্তেজনা। ২০১১ সালে নারায়নগঞ্জের নির্বাচন যেন পুরো দেশের নির্বাচনে পরিনত হয়েছিল। সেই সময়ে পুরো একটা মাস আমি নারায়নগঞ্জে ছিলাম। ওই সময়টায় খুব কাছ থেকে সব প্রার্থীকে দেখেছি, দেখেছি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি। সে এক উত্তেজনাপূর্ণ সময়। এরপর ২০১৬ সালের নির্বাচনটাও দেখেছি। সবকিছু ছাপিয়ে একজন প্রার্থী নিজেই কী করে একটা প্রতীকে পরিনত হয় তার প্রমাণ ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী। এটা তিনি একদিনে হননি।

আওয়ামী লীগ যে বছর ছয় দফা ঘোষণা করে সেই বছর ১৯৬৬ সালের ৬ জুন সেলিনা হায়াৎ আইভীর জন্ম। ভীষণ মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। ১৯৭৯ সালে ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র স্কলারশিপ পান। ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় স্টারমার্কসহ উত্তীর্ণ হন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৮৫ সালে রাশিয়া সরকারের বৃত্তি নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ওডেসা পিরাগোব মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন।

১৯৯২ সালে এমবিবিএস পাস করে দেশে এসে ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি সম্পন্ন করেন আইভী। কর্মজীবনে তিনি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সেখানে এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন।

আপনারা অনেকেই জানেন, আজকে নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশন সেটা একসময় পৌরসভা ছিল। আর আলী আহমেদ চুনকা ছিলেন স্বাধীনতার পর নারায়নঞ্জের প্রথম পৌর মেয়র। ওসমান পরিবারের বিরোধিতা সত্ত্বেও পরপর দুবার তিনি জিতেছিলেন। সেই আলী আহমেদ চুনকার কন্যা সেলিনা হায়াৎ আইভী।
আইভী ছাত্র অবস্থায় বাবার সাথে রাজনীতিেত যুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে জিতে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন আইভী। তিনি যখন মেয়রের চেয়ারে বসেছিলেন, তখন পৌরসভার দেনা ছিল দুই কোটি আট লাখ টাকা। সূর্য ডুবলেই শহর ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তায় বাতি জ্বলে না, একটু বৃষ্টি হলেই শহরে হাঁটুপানি জমে যায়। আছে আরও অনেক সংকট। ২০১১ সালে তিনি যখন ছাড়েন তখন পৌরসভায় জমা ১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, আরও ৪০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছিল।

এতো কিছুর পরেও তিনি কিন্তু ২০১১ সালের নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। সেবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে সবাই ছিলেন শামীম ওসমানের পক্ষে কারণ নিদর্লীয় নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ শামীম ওসমানকেই সমর্থন দি‌য়ে‌ছিল। আর আইভী নির্বাচন করেন নাগরিক কমিটির সমর্থনে।

ওই নির্বাচনের পুরোটা সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মুখে শুনেছি আইভী খুব খারাপ। বিএনপি জামায়াতের পুরোটা সময় আইভী নারায়নগঞ্জে আওয়ামী লীগের হাল ধরে থাকলেও কেউ কেউ বলেছেন আইভী আসলে আওয়ামী লীগই করে না। অনেকে তাকে বলেছেন সুশীল সমাজের প্রার্থী।

আওয়ামী লীগের লোকজন মনে করতো ওই নির্বাচনে শামীম ওসমান বিপুল ভোটে জয়ী হবেন। অথচ জনগন প্রকাশ্যে বা নিরবে শুধু আইভীর কথাই বলতেন। আমার মনে হতো, নারায়নগঞ্জের মানুষ বসে আছে আইভী আপাকে ভোট দেওয়ার জন্য।
আমার বেশ মনে আছে, নির্বাচনের আগের রাতে আমি আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতাকে বলেছিলাম সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতবে আইভী। হয়েছিলও তাই। জনতার রায়ে আইভীই জয়ী হয়েছিলেন। ২০১৬ সালেও সেই জনতা আইভী আপার পক্ষেই ফের রায় দেন। কাল নারায়নগঞ্জের তৃতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন।

আমি মনে করি এই নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভীর চেয়ে সৎ যোগ্য ও ভালো কোন প্রার্থী থাকলে হয়তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারত। ২০১১ সালে নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের হলফনামা দেখে একটা নিউজ করেছিলাম। শিরোনাম ছিল, শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের মামলা বেশি, তৈমূরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির। আইভীর বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই।

আমি নারায়ণগঞ্জের ভোটার নই। আমার ধারনা নিজের দারুণ সব কাজ, বাবার জনপ্রিয়তা, এবং নৌকা সবকিছু ছাপিয়ে আইভী নিজে যে প্রতীকে পরিনত হয়েছেন সেই প্রতীকে ফের জনগন ভোট দেবে। দেশের প্রতিটা জেলা, উপজেলায় সর্বত্র এমন জনবান্ধব রাজনীতিবিদেরা জয় লাভ করুন। অনেক অনেক শুভ কামনা
প্রিয় সেলিনা হায়াৎ আইভী, নারায়নগঞ্জের সবার আইভী আপা।

তবে ফল যাই হোক এই নির্বাচনটা যেন সুষ্ঠু হয়। এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনে তৈমুর আলম খন্দকার জিতে গেলেও সেটিকে শ্রদ্ধা করতে হবে। কারণ এই দেশে নির্বাচনব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছে তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন খুব জরুরী। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ঘোর বিরোধী আমি। আমি মনে করি এখানে ব্যক্তিই প্রাধান্য পাওয়া উচিত দল নয়। আর গণতন্ত্রের স্বার্থে সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি।

আপনার মতামত জানান