রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত তারই বিশ্বস্ত দেহরক্ষী

প্রকাশিত



রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় তারই বিশ্বস্ত দেহরক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে। পরিকল্পনার সময়ই তাকে ভাড়া করা হয়। আর তার মাধ্যমেই ডেকে এনে সফল করা হয় দেশে-বিদেশে চাঞ্চল্য তৈরি করা হত্যা মিশন। খুনের পেছনে এখন পর্যন্ত তিনটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র থেকে গতকাল মঙ্গলবার এসব তথ্য পাওয়া গেছে।রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দিতেও নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। এসব তথ্য এই হত্যা-রহস্যের জট খুলে দিচ্ছে।

এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কক্সবাজারের ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক নাইমুল হক সমকালকে বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার তদন্তে বেশ অগ্রগতি রয়েছে। কেন, কী কারণে, কারা এই হত্যায় জড়ায়- তার একটি পূর্ণ চিত্র আমরা পেয়েছি। যারা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়, তারা আরসা নামধারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। আরসার নামকে পুঁজি করে ক্যাম্পে চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে তারা। তবে সত্যিকার আরসার সঙ্গে তাদের সংশ্নিষ্টতা আমরা এখনও পাইনি। পরিকল্পনাকারীরা মুহিবুল্লাহর দেহরক্ষীকে বাগে নিয়েই হত্যার প্লট সাজায়। দেহরক্ষীর একটি বড় ভূমিকার কারণে নির্বিঘ্নে মিশন সফল হয়।নাইমুল হক আরও বলেন, তদন্ত যে পর্যায়ে আছে, এখন চাইলে অল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব। তবে আমরা আরও পাঁচজন আসামি গ্রেপ্তার ও কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করছি। যারা এখনও পলাতক, তারা কেউ দেশের বাইরে পালাতে পারেনি।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে নিজ কার্যালয়ে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হাতে খুন হন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ। এই হত্যাকাণ্ডের পর দেশে-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় প্রথমে আরসাকে দায়ী করেছিল নিহতের পরিবার। তবে পরে মুহিবুল্লাহ হত্যায় তারা জড়িত নয় বলে এক বিবৃতিতে দাবি করে আরসা। মুহিবুল্লাহকে ‘মাস্টার’ বলে সম্বোধন করতেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের যে কোনো বিপদে-আপদে ছুটে যেতেন তিনি। শিক্ষায় অনগ্রসর রোহিঙ্গাদের কাছে ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ ছিলেন সত্যিকারের আদর্শ। অনেকে তাদের ‘মুক্তির দূত’ হিসেবে বিবেচনা করতেন।তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দিতে এই হত্যায় ১৯ জনের সংশ্নিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নেয়। তারা সবাই ঘটনার সময় অস্ত্র হাতে ছিল। তবে তিনজন অস্ত্র ব্যবহার করেছে। হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া পাঁচজনের হাতে ছিল দেশি অস্ত্র।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, এই কিলিং মিশনে যারা অংশ নেয়, তারা প্রায় একটি নিখুঁত পরিকল্পনা করে। ছকের অংশ হিসেবে মুহিবুল্লাহর দেহরক্ষীকে হাত করা হয়। সাধারণত মুহিবুল্লাহ রাত ৮টার পর তার বাসার বাইরে থাকতেন না। নিরাপত্তার কারণে দীর্ঘদিন ধরে অন্যান্য রোহিঙ্গার মতো তিনিও এই নিয়ম মেনে চলতেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার রাতে দেহরক্ষী মোর্শেদ রাত ৮টার পর মুহিবুল্লাহকে তার বাসা থেকে ডেকে অফিসে নিয়ে আসেন। আগে থেকে তাকে বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়ে অফিসে আলাপ-আলোচনা হবে। মূলত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে তার ওপর হামলা চালানো হবে- এটা আগেই দেহরক্ষীর সঙ্গে হত্যা মিশনের অন্যরা ঠিকঠাক করে রাখে। রাত ৮টা ৪০ মিনিটে হত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগেই ওই দিন সন্ধ্যায় কিলিং মিশনের সদস্যরা ক্যাম্পে গোপন শেষ বৈঠকটি সেরে নেয়। একই মিশন নিয়ে দু’দিন আগেই তারা গোপন মিটিং করে। তবে তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, হত্যার পরিকল্পনাটি আরও আগে থেকে নেওয়া।

তদন্তে উঠে এসেছে, তিন কারণে মুহিবুল্লাহকে হত্যার ছক চূড়ান্ত করা হয়। এক. প্রত্যাবাসনের পক্ষে মুহিবুল্লাহর জোরালো ভূমিকা। ক্যাম্পে একটি পক্ষ প্রত্যাবাসনবিরোধী। তারা মনে করে, প্রত্যাবাসন শুরু হলেই তাদের ‘সাম্রাজ্য’ হারাতে হবে। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে দীর্ঘদিন ধরেই অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। দুই. ক্যাম্পে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বিশ্বাস করে, ক্যাম্পে তাদের নিরঙ্কুশ প্রভাববলয় তৈরিতে প্রধান বাধা মুহিবুল্লাহ। তিন. সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে মুহিবুল্লাহ ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তাও তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন- কুতুপালং ৭ নম্বর ক্যাম্পের নুর বাশারের ছেলে মো. ছলিম, মধুরছড়া ক্যাম্পের রহিম উল্লাহর ছেলে শওকত উল্লাহ, ১ নম্বর ক্যাম্পের জাকির আহমদের ছেলে জিয়াউল রহমান, ক্যাম্প-৮-এর মকবুল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ সালাম, ৬ নম্বর ক্যাম্পের রজক আলীর ছেলে হেড মাঝি মো. ইলিয়াছ, আজিজুল হক, নূর মোহাম্মদ, আনাছ, ক্যাম্প-১-এর আবদুল মাবুদের ছেলে মুহিবুল্লাহর দেহরক্ষী মো. মোর্শেদ, আবুল কালাম, নজিম উদ্দিন ও হামিদ হোসাইন। তাদের মধ্যে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন সালাম, ইলিয়াছ, নজিম ও হামিদ।এআরএসপিএইচ নামে সংগঠন গড়ে তুলে রোহিঙ্গাদের অধিকারের কথা বলতেন মুহিবুল্লাহ। আরাকানের মংডু টাউনশিপের সিকদারপাড়া থেকে ২০১৭ সালের আগস্টের পর পালিয়ে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেন মুহিবুল্লাহ।

আপনার মতামত জানান