কুরবানির বিকল্প কোনো ইবাদত নেই
বিশ্বময় মহামারি করোনার এ দিনে আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে ঈদুল আজহা। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকেই হয়তো ভাবছেন এবার কুরবানি না দিলে কি এমন ক্ষতি হবে। আসলে বিষয়টি এমন নয়।
পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সামর্থ্যবানদের অবশ্যই কুরবানিতে অংশ নিতে হবে। কেননা ইসলামে ঈদুল আজহার দিনে কুরবানি করার গুরুত্ব অপরিসিম।
রাসুল করিম (সা.) ‘ঈদুল আজহিয়া’ উপলক্ষে নিজেও কুরবানি করতেন এবং তার সাহাবিদেরকেও কুরবানি করার জন্য তাগিদ দিতেন। এ ব্যাপারে হাদিসে অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে।
যেমন হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) হিজরতের পর মদিনায় দশ বছর অবস্থান করেন এবং তিনি প্রতি বছরই ‘ঈদুল আজহিয়া’ উপলক্ষ্যে মদিনায় কুরবানি করতেন (তিরমিজি)।
শুধু তাই নয়, ঈদুল আজহার কুরবানির প্রতি রাসুলের (সা.) এতদূর খেয়াল ছিল যে, ওফাতের পূর্বে তিনি তার জামাতা ও পিতৃব্য পুত্র হজরত আলীকে (রা.) ওসিয়ত করেন, তার ওফাতের পর যেন মহানবীর (সা.) পক্ষে ঈদুল আজহিয়া উপলক্ষ্যে সর্বদা কুরবানি করা হয়। হজরত আলীও (রা.) তাই করেছিলেন যা মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছিলেন।
হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হজরত হাবসা (রা.) বলেন, তিনি হজরত আলীকে (রা.) দেখলেন ঈদুল আজহায় দু’টি দুম্বা কুরবানি করছেন। হজরত আলীকে (রা.) তিনি জিজ্ঞেস করলেন, দু’টি দুম্বা কোরবানি করার উদ্দেশ্য কী? এতে হজরত আলী (রা.) বললেন, আমাকে মহানবী (সা.) ওসিয়্ত করেছেন, আমি যেন মহানবীর (সা.) পক্ষে তার ওফাতের পরেও কুরবানি করতে থাকি। এজন্য তিনি হজরত রাসুলের (সা.) পক্ষে কুরবানি করেন (আবু দাউদ) ।
ঈদুল আজহার দিন কোরবানি করা মহানবীর (সা.) শুধু ব্যক্তিগত কর্মই ছিল না, বরং তিনি তার সাহাবাদেরকেও এর আদেশ দিতেন।
হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত বারা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) ঈদুল আজহার দিন খুতবা প্রদান করেন এবং বলেন, এ দিন প্রথমে মানুষ ঈদের নামাজ পড়বে এবং তারপর কুরবানি করবে। সুতরাং যে এমন করে, সে তার সুন্নতকে লাভ করেছে (বোখারি ও মুসলিম)।
আরেক স্থানে তিনি (সা.) বলেন, যার আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্বেও ঈদুল আজহিয়া উপলক্ষ্যে কুরবানি করে না, সে কেন আমাদের ঈদগাহে এসে নামাজে শামিল হয়? (মুসনাদ আহমদ)।
মহানবীর (সা.) এই আদেশকে সাহাবারা (রা.) খুব ভালভাবেই স্মরণ রেখেছিলেন আর সাধ্যমত তারা কুরবানি করতেন।
বর্ণনায় এসেছে, একবার এক ব্যক্তি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমরকে (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ঈদুল আজহার কুরবানি কি জরুরী? এতে তিনি বললেন, মহানবী (সা.) নিজে কুরবানি করতেন এবং তার অনুবর্তিতা রূপে সাহাবাগণও কুরবানি করতেন।
ওই ব্যক্তি তার প্রশ্নটি পুনরুত্থাপনপূর্বক বললেন, কুরবানি কি ওয়াজিব? হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) বললেন, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পার না? আমি স্পষ্ট করে বললাম, মহানবী (সা.) নিজেও কুরবানি করতেন এবং তার অনুবর্তীতায় অন্য মুসলমানরাও করতেন (তিরমিজি)।
ঈদুল আজহার দিন কোরবানি করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। যেমন হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত জায়েদ বিন আরকাম (রা.) বলেন, সাহাবায়ে কেরামরা মহানবীর (সা.) কাছে নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! ঈদুল আজহার এই যে কুরবানি, এটি কেন করা হয়?
এতে মহানবী (সা.) বললেন, এটি তোমাদের প্রধান পূর্ব পুরুষ ইব্রাহিমের প্রবর্তিত রীতি বা সুন্নত। এরপর সাহাবারা (রা.) নিবেদন করলেন, আমাদের জন্য এতে লাভ কী? তখন তিনি (সা.) বললেন, কুরবানির জন্তুর প্রত্যেকটি লোম কোরবানিকারীর জন্য এক একটি পুণ্য, যা তাকে আল্লাহতায়ালার কাছে পুরস্কার লাভের যোগ্য করে তুলবে (ইবনে মাজা)।
এ থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায়, ঈদুল আজহায় কুরবানির গুরুত্ব কত ব্যাপক। কুরবানির আদেশ রয়েছে বলে, যে কোন ধরনের পশু কুরবানি করলেই কিন্তু চলবে না।
মনে রাখতে হবে, কুরবানির পশু নিখুঁত হওয়া চাই। এব্যাপারে বিভিন্ন হাদিসেও উল্লেখ রয়েছে। হজরত আলী (রা.) বলেন, তিনি (সা.) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন কুরবানির পশুর চোখ, কান ভালভাবে দেখে নেই। যে পশুর কানের শেষ ভাগ কাটা গিয়েছে অথবা যার কান গোলাকার ছিদ্র করা হয়েছে বা যার কান পেছনের দিক থেকে ফেরে গিয়েছে তা দিয়ে আমরা যেন কোরবানি না করি (তিরমিজি)।
হজরত আলী (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) শিং ভাঙ্গা ও কান কাটা পশু দিয়ে আমাদেরকে কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন (ইবনে মাজাহ)। তাই এ বিষয়টির ওপর খুব গুরুত্ব দিতে হবে।
বর্তমান যেহেতু করোনাকাল চলছে, অনেক খেটে খাওয়া ও দরিদ্র মানুষ অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছেন, তাই এই ঈদে তাদের কথা চিন্তা করে আমাদেরকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে প্রকৃত অর্থে ঈদুল আজহার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কুরবানি করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
সূত্রঃ যুগান্তর।
আপনার মতামত জানান