ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ
বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে সর্বজনীন দাবির মুখে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ১০০ বছরে বলতে গেলে বাঙালির সব অর্জনের সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে আছে সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অর্জনগুলোর পেছনে অনন্য ভূমিকা রাখা দেশের এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এক জীবন্ত ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের এত অর্জন নেই। জাতির বাতিঘর হিসেবে যুগ যুগ ধরে আলো ছড়ানো এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আজ সীমিত পরিসরে প্রতীকী কর্মসূচির মাধ্যমে বিশেষ এ দিবস উদযাপিত হচ্ছে। নানা আয়োজনের মাধ্যমে শতবর্ষের বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ মূল অনুষ্ঠান আগামী ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তবে বিশেষ এই দিন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাবেক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
গতকাল বুধবার এক বাণীতে উপাচার্য বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে প্রিয় মাতৃভূমি ও গণমানুষের প্রতি আমাদের অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ গণমানুষের সব লড়াইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা নেতৃত্ব দিয়েছে। জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দেশ সেবায় রেখেছে অনন্য অবদান। দেশের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ ও চিরকৃতজ্ঞ চিত্তই এগিয়ে চলার পাথেয়।’
১৯৪৭ সালের পর রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনার ধারাবাহিকতায়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সব গণ-আন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্দয় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়। পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাতও হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ ছাড়া দেশবাসীর যেকোনো দাবি, আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্যতম কেন্দ্রস্থল যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন আগে ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি। ওই বছরের ২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ব্যারিস্টার আর নাথানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইনসভা পাস করে ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’। শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুল মতিন চৌধুরী, পদার্থবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কবি বুদ্ধদেব বসু, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমাম, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, লেখক জাফর ইকবাল, ইসলামী চিন্তাবিদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী।
প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং পরে দীর্ঘদিন এই শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকতা করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক প্রয়োজনে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা হয়েছে, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের চর্চা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সমিতি, ছাত্রসংসদ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গঠনমূলক কাজে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে এখন যে ছাত্রসংসদ নেই, সেটা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপূর্ণতা। এটি একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্ক থাকবে, সাংস্কৃতিক চর্চা হবে। কিন্তু এখন যেন এই কাজগুলো সেভাবে হচ্ছে না।’ এই শিক্ষাবিদ পরামর্শ দিয়ে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনতে হবে। তাঁরা শিক্ষাদানের পাশাপাশি গবেষণা করবেন, প্রকাশনা করবেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং শিক্ষকতাও করেন। তিনি বলেন, ১৯২১ সালে অক্সফোর্ডের আদলে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এর পর থেকে অদ্যাবধি জ্ঞানের প্রসার, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রসারে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ গঠনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অগ্রগামী। মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রায় সব ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, অতীতে যেভাবে জ্ঞানচর্চা ও সমাজ বিনির্মাণে এই বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রেখেছে, আগামী দিনেও তা যেন অব্যাহত থাকে।
সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ।
আপনার মতামত জানান